বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায়
বর্ষাকালে তো বটেই মাঝে মাঝে গ্রীষ্মকালেও ঝড় বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত হয় আমাদের দেশে। দিনে দিনে বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। আজকের এই লেখায় আলোচনা করা হবে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায় সম্পর্কে।
“দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা” এর আজকের পর্বে আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি বজ্রপাত সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। যেমন বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায়, বজ্রপাত কতটা শক্তিশালী, বাংলাদেশে বজ্রপাতের কতটা ভয়ংকর অবস্থা ইত্যাদি।
বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায়
বাংলাদেশে যতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে তার মধ্যে ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত অন্যতম মারাত্মক। এই দুটোর মধ্যে আবার বজ্রপাত সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ ভূমিকম্পের মতোই বজ্রপাতের পূর্বাভাসের কোনরকম প্রযুক্তি বা যন্ত্র এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। আবার বজ্রপাত প্রতিরোধে কিংবা বজ্রপাতে যেন কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ারও কোন সুযোগ নেই।
বর্ষাকাল এলে সংবাদপত্র কিংবা পত্র-পত্রিকায় বজ্রপাতে অথবা বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মানুষের প্রাণহানীর খবর অহরহ শোনা যায়। প্রাকৃতিক কিছু কারণ যেমন অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কেটে ফেলার পাশাপাশি সামাজিক অব্যবস্থাপনাও মূলত দায়ী এ বজ্রপাতের জন্য।
তাছাড়া মানুষের অসচেতনতা তো রয়েছেই। তাই ববজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায় বলতে কিছু পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ থাকলেও মূলত সচেতনতাই বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার প্রধান হাতিয়ার। তো চলুন বজ্রপাত থেকে বাঁচার করণীয় গুলো কি কি তা জেনে নেই।
- সাধারণত বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি হয় এবং মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময়ে ঝড় বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত হলে প্রায় আধাঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তাই এ সময়টুকুতে অতি সাবধানতা অবলম্বন করুন।
- উপরে উল্লেখিত সময়ে আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং ঘরে সতর্কতার সাথে অবস্থান করুন।
- এমতাবস্থায় বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে খোলা আকাশের নিচে যেন না থাকেন।
- ঝড়-বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলে অবশ্যই ধাতব হাতে যুক্ত ছাতা ব্যবহার করবেন না। সম্ভব হলে প্লাস্টিক অথবা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন।
- খোলা জায়গা, খোলা আকাশের নিচে অথবা উঁচু স্থান যেমন পাহাড়ে থাকলে বজ্রপাত শুরু হলে দ্রুত সেই সব স্থান ত্যাগ করে কোন ভবন যেমন দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, অফিস আদালত ইত্যাদিতে অথবা বাড়িতে অবস্থান করুন।
- বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ বা ধান খেতে যদি অবস্থান করেন এবং দ্রুত ধান ক্ষেত থেকে চলে যাওয়া সম্ভব না হয় তবে মাথা নিচু করে দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে পড়ুন।
- বজ্রপাত না হলেও আকাশে কালো মেঘ দেখামাত্রই সাগর, নদী, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি থেকে দূরে অবস্থান করুন।
- বজ্রপাতের সময় গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বৈদ্যুতিক ধাতব খুটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূরে অবস্থান করুন।
- বাড়িতে অবস্থানকালে বজ্রপাত শুরু হলে বাড়ির সকল ধাতব পাত যেমন জানালার গ্রীল, টিনের দরজা, স্টিলের বিভিন্ন আসবাবপত্র ইত্যাদি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
- বাড়িতে থাকাকালে বজ্রপাত শুরু হলে জানালার ধারে কিংবা বারান্দায় যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- বজ্রপাতের সময় যেকোনো যানবাহনে অবস্থান করলে যানবাহনের ধাতব অংশের সাথে শরীরের স্পর্শ যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। সম্ভব হলে বাহনটিকে কোন কংক্রিটের ছাউনির নিচে রাখুন।
- ঝড়-বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সময় বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যেমন টেলিভিশন, ফ্রিজ, ওভেন, ফ্যান, কম্পিউটার-ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে প্রতিটি জিনিস বন্ধ রাখুন।
- বন্ধ রাখার পাশাপাশি প্রতিটি ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের প্লাগ লাইন বা বৈদ্যুতিক বোর্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করুন।
- বজ্রপাত হলে বৈদ্যুতিক সুইচ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- বজ্রপাতের সময় শুধু বড়রা নন শিশুদেরও বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখুন।
- বজ্রপাতের সময় নদী বা সমুদ্রে মাছ ধরার সময় অবশ্যই ট্রলারে অথবা নৌকায় ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।
- বজ্রপাতের ঝুঁকি এড়াতে সকল আবাসিক ভবন এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বজ্র নিরোধক দন্ডের স্থাপন নিশ্চিত করুন।
- যে কোন ভবনের থাকাকালীন অবস্থায় বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হলে বজ্রপাতের ঝুঁকি এড়াতে সকল ব্যক্তি এক জায়গায় না থেকে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করুন।
- খোলা জায়গায় একসাথে অনেক জন থাকাকালে বজ্রপাত শুরু হলে নিকটবর্তী কোন ভবন না থাকলে প্রত্যেকে একেক জন থেকে প্রায় ৩০-৪০ ফিট দূরত্বে অবস্থান করুন।
- বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তিদের মতো করেই বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির চিকিৎসা করতে হবে। তাই বজ্রপাতে কেউ আহত হলে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তার পাশাপাশি ডাক্তার ডাকতে হবে অথবা খুব দ্রুত হাসপাতালে রোগীকে নিতে হবে।
- বড় কোন খোলা জায়গা কিংবা মাঠের মাঝখানে অবস্থানকালে বজ্রপাত শুরু হলে নিকটবর্তী কোন বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। গাছ থেকে অন্তত ১০ মিটার দূরে অবস্থান করুন।
- বজ্রপাত থেকে আপনার বাড়ি অথবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কে নিরাপদ করতে আর্থিং যুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করতে হবে। কারণ ভুল ভাবে স্থাপিত আর্থিং রড বজ্রপাতের ঝুঁকি আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
- বিশেষজ্ঞদের মতে বজ্র মানে হচ্ছে বিদ্যুৎ। তাই বজ্রপাতের সময় নিরাপদ থাকতে হলে রাস্তার দুই ধারে প্রচুর পরিমাণে উঁচু গাছ অর্থাৎ তালগাছ, ডাব গাছ, মেহেগুণী গাছ ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।
- ভবনে আর্থিং ব্যবস্থা থাকলে সেই আর্থিং রড এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ টেনে নেয় ফলে ভবন এবং বৈদ্যুতিক খুঁটির চারপাশ নিরাপদ থাকে। তবে বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছে দাঁড়ানো উচিত নয় কারণ বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শোষণের সময় মানুষ বা গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে বজ্রপাত
আবহাওয়াবিদদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী অতিরিক্ত উত্তপ্ত এবং একই সাথে আর্দ্র আবহাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে বজ্রপাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং তাপমাত্রা দিনের দিন বেড়েই চলেছে। বজ্রপাতে শুধু মানুষের প্রাণহানি ঘটে তা নয় বিভিন্ন গবাদি পশুরও প্রাণহানি ঘটে থাকে।
অবশ্যই পড়ুনঃ ভালো বস হওয়ার উপায় | জেনে নিন ১৪ টি গুণাবলী
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় শতাধিক মানুষ শুধুমাত্র বজ্রপাতের কারণেই মারা যায়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে গড়ে প্রায় ৩০০ লোক মারা যায় বজ্রপাতের আঘাতে। বজ্রপাতে মৃত্যুর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, পর্যাপ্ত সর্তকতা ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, গাছ কেটে ফেলা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বজ্রপাতে প্রাণহানির অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে উপরিউক্ত কারণ গুলোর জন্য গোটা বিশ্বে এবং এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বজ্রপাতে প্রাণহানির ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বজ্রপাত কি এবং বজ্রপাত কিভাবে সৃষ্টি হয়
বায়ুমণ্ডলের নিচের অংশের তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং যত উপরের দিকে যাওয়া যায় তাতে তাপমাত্রা কম থাকে। অনেক সময় দেখা যায় বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে থাকা হালকা মেঘ দ্রুত গতিতে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই মেঘগুলো যত উপরের দিকে উঠতে থাকবে তত এগুলো খুব দ্রুত ঠান্ডা হতে থাকে।
মেঘে সাধারণত ক্ষুদ্র জলীয় বাষ্প বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণা থাকে যেগুলো সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না। এইভাবে মেঘ উপরে উঠতে থাকে আর তাতে পানির ঘনত্ব বাড়তে থাকে অর্থাৎ পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। একটা সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলীয় বাষ্পের পানি কণাগুলো একসাথে থাকতে পারে না। ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পারস্পরিক বন্ধন ছিন্ন করে।
পানির কনা গুলো আলাদা হওয়ার সময় আধান বা বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। ফলে এসব আধান বা বৈদ্যুতিক চার্জের পরিমাণ বায়ুমন্ডলের নিচের অংশের আধান বা চার্জের তুলনায় পরিমাণে বেশি হয়। এতে করে চার্জের পার্থক্যের সৃষ্টি হওয়ায় বৈদ্যুতিক চার্জগুলো নিচের দিকে নির্গমন হতে শুরু করে। বৈদ্যুতিক চার্জগুলোর নিচের দিকে এ ধরনের আকস্মিক নির্গমনের ফলেই আকাশে আলোর এক ধরনের ঝলকানি সৃষ্টি হয়।
আর এটি সংঘটনের সময় বায়ুমন্ডলের বাতাসের প্রচণ্ড গতিতে সংকোচন এবং প্রসারণ ঘটে হলে বিকট শব্দের সৃষ্টি হয় যেটিকে আমরা বজ্রপাত বলি। এভাবে বৈদ্যুতিক চার্জের আদান-প্রদান বা স্থানান্তর দুটি মেঘের মধ্যে ঘটতে পারে আবার একটি মেঘ এবং ভূমির সাথেও ঘটতে পারে। আর মেঘ এবং ভূমির মধ্যে এরূপ বৈদ্যুতিক চার্জের স্থানান্তরের সময় যে বজ্রপাত সৃষ্টি হয় তাতে যদি কোন মানুষ বা গবাদি পশু থাকে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হয়।
বজ্রপাত কতটা শক্তিশালী
শক্তির এসআই একক জুল এবং বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপ করার একক হল কিলোওয়াট/আওয়ার। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরত্ব উচ্চতার একটি বজ্রপাত থেকে এক বিলিয়ন থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন জুল পর্যন্ত শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। একটু হিসাব করে দেখা যাক। ১ জুল = ২.৭৮×১০−৭ kW⋅h হলে ১ বিলিয়ন জুল = ২৭৮০০ কিলোওয়াট/আওয়ার।
আমাদের দেশে একটি সাধারণ পরিবারে মাসে ১৫০ ইউনিট অর্থাৎ কিলোওয়াট/আওয়ার বিদ্যুৎ খরচ হলে বছরে ১৮০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। তাহলে ২৭৮০০ কিলোওয়াট/আওয়ার বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব হলে (যা প্রায় অসম্ভব) তা দিয়ে একটি পরিবার প্রায় ১৫ বছর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে বিনা খরচে। বিস্ময়কর একটি হিসাব।
পরিশেষে
বজ্রপাতে অসাবধানতাই কেড়ে নিতে পারে একটি জীবন হোক সেটা মানুষের অথবা গবাদি পশুর। কোন মানুষ বা প্রাণী বজ্রপাতের কবলে পড়লে তার বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ১% অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যু। কেবল সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরাই বেঁচে যান যদিও তাদের বিভিন্ন অঙ্গহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই আসুন আমরা নিজে সচেতন হই বজ্রপাত সম্পর্কে এবং অন্যকে সচেতন করি, জীবন বাঁচাই।
বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায় সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করলাম। আপনাদের সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি। পরবর্তীতে নতুন কোন টপিক নিয়ে আবার হাজির হব। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করতে পারেন আর লেখায় ভুল ত্রুটি থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। এই ওয়েবসাইট নিয়মিত ভিজিট করা অনুরোধ থাকলো। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url