ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী
কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? কিন্তু কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না? তাহলে আপনি সঠিক আর্টিকেল পড়ছেন। ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী থেকে যেটি রাজশাহীর একটি দর্শনীয় স্থান। জানুন ইতিহাস দেখুন সৌন্দর্য।
“ভ্রমণ গাইড” এর আজকের পর্বে আমরা রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ী ভ্রমণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। আপনি নিজে ঘুরে এসে যদি মজা পেয়ে থাকেন তাহলে সহজে অন্যকে পরামর্শ দিতে পারবেন- ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী থেকে। কিভাবে যাবেন, দূরত্ব, খরচ, এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে চলুন জেনে নেই।
ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী
বাংলাদেশের যতগুলো ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ী অন্যতম। কাজের প্রচণ্ড চাপে অথবা লেখাপড়ার ফাঁকে মানসিক অবসাদ খুঁজতে যারা পুঠিয়া রাজবাড়ী ভ্রমণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কম দূরত্বে এবং স্বল্প খরচে একটি দুর্দান্ত ভ্রমণ হতে পারে পুঠিয়া রাজবাড়ীতে। তাহলে ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী থেকে। চলুন জেনে নেই ভ্রমণের বিস্তারিত।
যেভাবে যাবেন পুঠিয়া রাজবাড়ি
প্রথমে অন্য অঞ্চলের কথাই বলি। বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে রাজশাহী গামী যে কোন বাস অথবা ট্রেনে নাটোরে নেমে রাজশাহী গামী যে কোন বাসে আসলে পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ডে নামতে হবে। ঢাকা থেকে রাজশাহী গামী বিভিন্ন ট্রেনের মধ্যে রয়েছে সিল্কসিট এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, ধুমকেতু এক্সপ্রেস এবং বনলতা এক্সপ্রেস।
আরও জানুনঃ ইউটিউব থেকে আয় হালাল নাকি হারাম?
এছাড়া ঢাকা থেকে রাজশাহী গামী বিভিন্ন এসি বাসের মধ্যে রয়েছে গ্রীন লাইন, একতা, ন্যাশনাল ট্রাভেলস ও দেশ ট্রাভেলস। এগুলোর ভাড়া ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকার ভিতর। এছাড়া নন এসি বাসের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ট্রাভেলস, হানিফ, শ্যামলী ইত্যাদি যেগুলোর ভাড়া ৭১০ থেকে প্রায় ৮০০ টাকার ভিতর। পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে রাজবাড়ী পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য অটো ভ্যান এবং রিক্সা রয়েছে।
তবে সবচেয়ে সহজলভ্য হলো ভ্যান জন প্রতি পাঁচ টাকা করে ভাড়া। পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে রাজবাড়ীর দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এ দূরত্ব হেঁটে যেতে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগে। এবার আসি রাজশাহী থেকে উঠিয়া আসার ব্যাপারে। রাজশাহী সদর থেকে পুঠিয়ার দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। রাজশাহী থেকে নাটোর মহাসড়ক অভিমুখে পুঠিয়া অবস্থিত।
রাজশাহী থেকে যদি উঠে রাজবাড়ি যেতে চান তবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল অথবা ভদ্রার মোড় থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক বাস রয়েছে। যেকোনো একটি বাসে উঠে গেলে পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে যেতে পারবেন। জন প্রতি ভাড়া ৫০ টাকা। পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ভ্যানে করে রাজবাড়ীর গেটে আপনাকে নামিয়ে দেবে।
এরপরে আশেপাশের বিভিন্ন দিঘী এবং মন্দির পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে আপনি রিজার ভ্যান ভাড়া নিতে পারেন। রাজশাহী শহরে ভদ্রার মোড় থেকে পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড যেতে বাসে লাগতে পারে ৪৫ মিনিটের মত তবে নিজস্ব বাইক থাকলে ৩০ মিনিটের মধ্যে যাওয়া যায়।
বাস এবং ট্রেন ছাড়াও আকাশ পথের ব্যবস্থা রয়েছে ঢাকা থেকে রাজশাহী আসার। এক্ষেত্রে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর সাহায্যে রাজশাহী আসতে পারেন যার ভাড়া জনপ্রতি ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা।
রাজবাড়ীর প্রবেশ মূল্য এবং সময়
অনেক আগে থেকেই পুঠিয়া রাজবাড়ীতে কোন প্রবেশ করল না থাকলেও সম্প্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে জনপ্রতি। সপ্তাহের সোমবার ছাড়া প্রত্যেক দিনই সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত পুঠিয়া রাজবাড়ী পরিদর্শনের সুযোগ থাকছে।
পুঠিয়া রাজবাড়ীর ইতিহাস
সপ্তদশ শতকে পোর্টের জমিদারি ছিল সেই আমলের অন্যতম প্রাচীনতম জমিদারি প্রথা। সেই সময়ের তৎকালীন শাসক মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করার পর সিরাজের বাড়ি এটি পুঠিয়া রাজবাড়ী রূপে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে সে রাজার সম্পত্তি ভাগ হলে বড় সন্তান পায়ে সাড়ে পাঁচ আনা এবং অন্য তিন ছেলেপন সাড়ে তিন আনা করে।
বড় সন্তান এবং তার স্ত্রী মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবীর পুত্র যতীন্দ্র নারায়ণ ১৮৮০ সালে ঢাকা জেলার বিশিষ্ট জমিদার ভুবন মোহন রায়ের কন্যা হেমন্ত কুমারী দেবীকে বিয়ে করেন। এক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর মা মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবী বিভিন্ন কারণে ব্যক্ত বিরক্ত হয়ে ভারতের কাশি চলে যান।
আরও জানুনঃ শরীরের জন্য অপরিহার্য খনিজ উপাদান
এরপর জমিদারীর দায়িত্ব এসে পড়ে তার পুত্রবধূ হেমন্ত কুমারী দেবীর উপর মাত্র ১৮ বছর বয়সে। শাশুড়ি মহারানীর শরৎ সুন্দরী দেবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পুঠিয়া রাজবাড়ী নির্মাণ করেন মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী এবং তিনি সেখানে বসবাস করতে থাকেন।
পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে তিনি মারা যাওয়ার পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রয়ে যায় বর্তমানের দৃশ্যমান পুঠিয়া জমিদার বাড়িটি। পুঠিয়া রাজবাড়ী পাঁচআনি জমিদার বাড়ি নামেও পরিচিত। বর্তমানের পুঠিয়া জমিদার বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
জমিদার বাড়ির নির্মাণশৈলী
পুঠিয়া রাজবাড়ী দূর থেকে দেখলে শুধু মনোরম লাগবে তা নয় কাছে থেকে দেখলে এর সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হতেই হয়। বহু কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবনের রাজবাড়ীর সামনে বেশ কয়েকটি উঁচু এবং বৃহদাকার স্তম্ভগুলো সকলেরই নজর কাড়ে। ভবনের ছাদ রয়েছে একদম সমতল ছাদের ভেতরের দিকে রয়েছে লোহার বীম, কাঠের বর্গা ও টালির সমন্বিত সজ্জিত নির্মাণ।
রাজবাড়ীর দোতলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কক্ষ যেগুলো বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব কক্ষে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এর ছবি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। ভবনের বারান্দায় কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়ালে, দরজার উপর ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য যে কারো মন ছুয়ে যায় এবং নিয়ে যায় সেই প্রাচীন কালের জমিদার ব্যবস্থাপনায় যা সেই সময় ছিল সম্ভ্রান্ত এবং আভিজাত্যের প্রতীক।
পুঠিয়া রাজবাড়ীর আশেপাশে দর্শনীয় স্থান
পুঠিয়া জমিদার বাড়ি যাওয়ার পূর্বেই সবচেয়ে বড় যে মন্দিরটি চোখে পড়বে অনেক দূর থেকে সেটির নাম হচ্ছে বড় শিব মন্দির। এই মন্দিরের পেছনদিকেই রয়েছে একটি বড় দিঘী। বড় শিব মন্দির ছেড়ে আরেকটু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে চারতলা বিশিষ্ট দোল মন্দির যেটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়াও রাজবাড়ীর পেছনে রয়েছে গোবিন্দ মন্দির, কিছুটা দূরে আরো দুই তিনটা মন্দির এবং এই মন্দির গুলোর আশেপাশে রয়েছে আরও বেশ কিছু দিঘী।
পুঠিয়া রাজবাড়ীর চারপাশে সব মিলিয়ে মোট পাঁচ থেকে ছয়টি মন্দির এবং দীঘি রয়েছে। মন্দির গুলোর মধ্যে বড় শিব মন্দির ছাড়াও গোপাল মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, আন্হিক মন্দির উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রাজবাড়ীর পাশে রয়েছে একটি পুকুর যেটির ঘাট সংলগ্ন কিছুটা অংশ দেয়াল দিয়ে বাধানো সম্ভবত এখানে মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী স্নান করতেন।
প্রতিটা দিঘী অনেক বড় বড় এবং দিঘির চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন গাছপালা রয়েছে ফলে প্রত্যেকটি দিঘির সৌন্দর্য অতুলনীয়। প্রতিটা মন্দিরে বাংলার বিভিন্ন গঠন রীতির যে আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী সেটা যে কোন পর্যটককে মুগ্ধ করবে। রাজবাড়ী পরিবেষ্টিত চারপাশে যতগুলো দীঘি রয়েছে তাদের রয়েছে বৈচিত্র ময় নাম যেমন গোপাল চৌকি, মরা চৌকি, শিব সাগর ইত্যাদি।
থাকার ব্যবস্থা
যারা ঢাকা বা অন্য কোন বিভাগ থেকে রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি দেখতে আসবেন তাদের জন্য একই দিনে দেখে ঘুরে যাওয়া কষ্টকর তাই তাদের রাতে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। রাতে থাকার জন্য পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ডে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে বিভিন্ন মানের। এছাড়া জেলা পরিষদের অধীনস্থ দুটি ডাক বাংলো রয়েছে।
এই ডাক বাংলোতে থাকতে হলে পূর্বেই আপনাকে জেলা পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া সরাসরি রাজশাহীতে আসলে রাজশাহী সদরে উন্নতমান থেকে মাঝারি মানের বেশ আবাসিক হোটেল রয়েছে। নগরীর সাহেব বাজার এলাকায় নাইস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, হোটেল হক্স ইন, নগরীর রেলগেট এলাকায় ডালাস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল সহ আরো বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব আবাসিক হোটেলে ৫০০ থেকে ৪০০০ টাকায় বিভিন্ন মানের রুম পাওয়া যাবে।
মন্তব্য
পুঠিয়া রাজবাড়ী বাংলাদেশের বিশেষ করে রাজশাহীতে অবস্থিত নজরকাড়া স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও জ্ঞান অর্জন এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য যে কেউ বিশেষ করে রাজশাহীবাসী স্বল্প দূরত্বের এ নিদর্শন যেকোনো সময় দেখে আসতে পারেন। আমি যে কাউকে পরামর্শ দেব ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ী থেকে।
তবে সকলের কাছে একটি অনুরোধ থাকবে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পর্যটন স্থানে আমাদের সম্পদ। সে সম্পদ গুলো পরিদর্শন করে জ্ঞান অর্জন এবং মানসিক তৃপ্তির পাশাপাশি সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের। আমরা কেউ এসব জাতীয় সম্পদের ক্ষতি করব না।
যারা পুঠিয়া রাজবাড়ী ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন তাদের জন্য সকল রকমের তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করলাম আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে। পুঠিয়া রাজবাড়ি ভ্রমণ করে এসে কেমন লাগলো সেই অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন কমেন্ট বক্সে। এ ধরনের আরও তথ্যবহুল লেখা পড়তে চাইলে Mubin Pedia নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url