সাদ্দাম হোসেন | নায়ক নাকি খলনায়ক? | জানুন সাদ্দাম এর শোচনীয় পতন | পর্ব ০৩

‘সাদ্দাম হোসেন’ নিবন্ধের তৃতীয় পর্বে আপনাকে স্বাগতম জানাই। আশা করি গত দুটি পর্ব আপনি পড়েছেন। প্রথম পর্ব না পড়ে থাকলে এখানে ক্লিক করুন এবং দ্বিতীয় পর্ব না পড়ে থাকলে এখানে ক্লিক করুন
সাদ্দাম হোসেন | নায়ক নাকি খলনায়ক? | জানুন সাদ্দাম এর শোচনীয় পতন

“বিশ্ব ব্যক্তিত্ব” এর আজকের এই পর্বে আমরা জানবো ইরাকের সাবেক প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট এর শোচনীয় পতন সম্পর্কে। আমরা আরো বোঝার চেষ্টা করব ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন নায়ক নাকি খলনায়ক ছিলেন!

সাদ্দাম যেভাবে ধরা পড়েন

২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকের সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও প্রায় আট মাস ইরাকের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে ছিলেন। কয়েক মাস ধরে মার্কিন সেনাদের শত শত অভিযানেও সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়ছিলেন না। অবশেষে ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিকরিত শহরের কাছে একটি খামার বাড়িতে সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়েন স্থানীয় সময় রাত ৮ টায়। 

সেই খামার বাড়ির ভূ গর্ভস্থ একটি বাঙ্কারে সাদ্দাম হোসেন লুকিয়ে ছিলেন। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না যে এখানে কোন প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং এর ভেতরে কোন মানুষ থাকতে পারে। মাটির উপর একটি ছোট্ট ঘর একটা সাধারণ মানুষ ঠিক মত থাকতে পারবে না এরকম এবং তার পাশে গৃহস্থালির নানা ভাঙ্গা জিনিসপত্রের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 
বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই পুরো অংশটাই ঢাকা ছিল একটি ছোট্ট গর্তে এবং গর্তের মুখে নোংরা কাঁথা দিয়ে ঢাকা ছিল। প্রায় দুই দশক সরাসরি নিজ হাতে স্বৈরশাসন কায়েম করার পর এবং মার্কিন বাহিনী দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আট মাস পালিয়ে থাকার পর এই সেই জায়গা যেখানে সাদ্দাম হোসেন লুকিয়ে ছিলেন। 

সাদ্দামকে আটক করা মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মাটির নিচে যে ঘর থেকে সাদ্দামকে আটক করা হয় সেখানে পাশাপাশি দুটি খাট পাতা ছিল। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নতুন কেনা কয়েক জোড়া জুতো পড়েছিল। ঘরের এক কোনায় একটি ছোট্ট ফ্রিজ ছিল তাতে ছিল কয়েক ধরনের কমল পানীয়, হট ডগ এর প্যাকেট এবং চকলেটের প্যাকেট যেটির মুখ খোলা ছিল। 

মূলত সেদিন মার্কিন সেনারা হতাশ হয়েই ফিরে যাচ্ছিলেন সাদ্দাম হোসেনকে না পেয়ে কিন্তু যাওয়ার পথে সেনাদের ভিতরে একজনের হঠাৎ সন্দেহ হয় নোংরা কাথাটি দেখে। তিনি কাথাটি সরালে দেখতে পান গর্ত এবং আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তারা প্ল্যান করল এখানে ছোটখাটো বোমা নিক্ষেপ করার জন্য। 

কিন্তু ততক্ষণে দুটি সাদা হাত দেখতে পান তারা। আস্তে আস্তে ব্যক্তিটি অর্থাৎ সাদ্দাম হোসেন সামনে এসে মার্কিন সেনাদের নিজের পরিচয় দিয়ে সমঝোতা করার প্রস্তাব দেন। সাথে সাথে সেনাদের একজন তার কাছে থাকা রাইফেলের বেওনেট দিয়ে সাদ্দামের মাথায় আঘাত করেন এবং সাদ্দামের কাছে থাকা পিস্তল নিয়ে নেন। 

তাছাড়াও সেই সময় সাদ্দামের কাছে ছিল ak 47 রাইফেল এবং প্রায় ৭ লক্ষ ডলার। ধরার পর তাকে ইরাকের প্রশাসন অথবা সাধারণ জনগণ কেউ চিনতে পারেননি। সাদ্দামের ধরা পরার পরে গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিগুলিতে অত্যন্ত বিধ্বস্ত, চিন্তিত, অপরিচ্ছন্ন, কাঁচা পাকা লম্বা চুল দাড়িতে মুখ ঢাকা অবস্থায় সাদ্দামকে দেখা যায়।

সাদ্দাম হোসেনের পতন

যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছিল পরবর্তীতে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। কয়েক দশক ধরে ইরাকের বিরুদ্ধে এরকম ভিত্তিহীন অভিযোগ থাকলেও ইরাক তথা সাদ্দাম হোসেনের সরকার পতনের জন্য কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে মূলত কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। 

ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হোসেন এবং তার সরকারের পতন নিশ্চিত করা। মূলত কুয়েত আক্রমণের পর থেকেই ইরাককে দমানোর সবরকম পাঁয়তারা প্রস্তুত করে রেখেছিল মার্কিন বাহিনী। এসব পাঁয়তারার প্রথম পদক্ষেপ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহপালিত পোষ্য সংগঠন জাতিসংঘের মাধ্যমে ইরাকের উপর ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেগুলোর অধিকাংশই ছিল অনৈতিক এবং অযৌক্তিক। 

ইরাকের আকাশ সীমানায় কুর্দিদের রক্ষার মিথ্যে অজুহাতে নো ফ্লাইজন জোর করে আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। পরবর্তীতে জাতিসংঘে পাশ্চাত্য নেতাদের সম্মতিতে একটি বিল পাস করা হয় যেটিতে বলা হয় ইরাকে সব ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মূল করা হবে। এরপর ইউএনএসকম নামে অস্ত্র পরিদর্শনকারী একটি দল ইরাকে গিয়ে কোন ধরনের অস্ত্র পাইনি। 
এরপরেও যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ বসে থাকেনি মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ইরাক ধ্বংসের খেলায়। কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাক লিবারেশন অ্যাক্ট নামে একটি আইন প্রণয়ন করে যেটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে যুক্ত হয় অর্থাৎ ইরাক পতনে আর তেমন কোন বাধা থাকছে না। এরপর ইরাকে “অপারেশন ডেজার্ট ফক্স” নামে প্রথমবারের মতো হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। মূলত সেখান থেকেই ইরাকে হামলা করে সাদ্দাম হোসেনের পতনের সূচনা করা হয়। 

যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের সাথে ইরাকের সেনাদের সীমান্ত বরাবর ছোটখাটো হামলা প্রতিনিয়ত হতেই থাকতো। এছাড়াও ইরাকের আকাশ সীমানায় নো ফ্লাইট জন এ লেখাগুলো ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাকের মাঝে আকাশ পথে ছোটখাটো গোলাগুলি হত। এরই মধ্যে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। 

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নাইন ইলেভেনের ঘটনার প্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের উপর হামলা করে দেশটির প্রধান কে ক্ষমতাত করতে বাধ্য করেন এবং দেশটিকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। আফগানিস্তানের উপর হামলা ছিল জর্জ ডব্লিউ বুশের ধ্বংসলীলার প্রথম ধাপ। এরপর বুশের মন্ত্রণালয় ইরাকের উপর সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একমত হয়। 

কারন আন্তর্জাতিক বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ হিসেবে ইরাক তেল রপ্তানিতে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং মার্কিনিদের উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই হোক ইরাককে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক তেল বাণিজ্য উপদেষ্টার বরাত দিয়ে জানা যায় ক্ষমতায় আসার পরপরই বুশ ইরাকের সরকার উচ্ছেদের বিষয়ে গোপন বৈঠক নিয়মিত করতেন। 

অপরদিকে বুশ ছোটখাটো হামলা পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে থাকল ইরাকে। এরপর ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র “অপারেশন সাউদার্ন ফোকাস” নামে আরেকটি হামলা পরিচালনা করে ইরাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে ইরাকের নিরাপত্তা দুর্বল হতে থাকে এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে তদারকি করতে শুরু করে উড়ে এসে জুড়ে বসা মার্কিন যুদ্ধবাহিনী। 

একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কুখ্যাত বুশ একটি জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রদান করে যেটিতে বলা হয় রাসায়নিক পারমাণবিক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ, সংরক্ষণ ও উৎপাদন করে এরকম কোন দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি স্বরূপ হয় তবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের সম্পূর্ণ নির্মূল করা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মাধ্যমে আরেকটি প্রস্তাব পাস করায় যার মাধ্যমে ইরাকে বাধ্যতামূলকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্র পর্যবেক্ষণ এর উদ্দেশ্যে একটি টিম পাঠানো হয়। 

এরপর ২০০৩ সালের শুরুর দিকে জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে যুদ্ধ শুরুর জন্য জাতিসংঘের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই মার্কিন কংগ্রেস থেকে সব রকমের সম্মতি এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২০০৩ সালের ১৭ মার্চ বুশ এক ঘোষণায় ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরাক ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিন দিনের মধ্যে। কিন্তু যুদ্ধবাজ বুশ সাদ্দামকে ইরাক ছেড়ে চলে যেতে বলেও ক্ষান্ত হয়নি। সেই ঘোষণার ৯০ মিনিটের মাথায় তিন দিনের মধ্যে ইরাকে হামলার কথা ঘোষণা করে সে। 

২০০৩ সালের ২০ মার্চ বুশের নির্দেশে ইরাকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ছেলে যুক্তরাজ্য ডেনমার্ক সহ আরো বেশ কিছু মিত্র দেশের সেনাবাহিনী। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেই ইরাকের মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহ দখল করতে শুরু করে মার্কিন বাহিনী। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে বাগদাদ দখল করে। 

দখল করার পরে মার্কিন মার্কিন সেনাবাহিনীরা সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভেঙে ফেলে এবং এই দৃশ্য পাশ্চাত্যসহ গোটা বিশ্বে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় এবং পশ্চিমারা এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করে। শুধু তাই নয় বুশের মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এবং মার্কিন গণমাধ্যম সহ পশ্চিমের বেশ কিছু গণমাধ্যম ইরাকীদের ওপর মার্কিনিদের এই আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। 

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২১ দিন টানা যুদ্ধ চলে এবং ২০০৩ সালের ১লা এপ্রিল যুদ্ধবাজ বুশ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ অবসান ঘোষণা করে। মার্কিন হামলাকারীরা ইরাকের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সময় যুদ্ধ চালানোর পাশাপাশি সাদ্দাম হোসেনকে চিরুনি অভিযান এর মত করে খুঁজতে শুরু করে, সব জায়গায় তল্লাশি চালায়। 

২০ মার্চ ইরাকে হামলার পরপরই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তিনি জীবন বাঁচাতে পুরো ইরাকের এই প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিলেন। শত চেষ্টা করেও সাদ্দাম নিজেকে আর রক্ষা করতে পারেননি। ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দী হন তিনি। 
এরপর তাকে ইরাকের একটি কারাগারে বন্দি রাখা হয় এবং ইরাকের একটা আদালতে দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর লোক দেখানো প্রহসনের বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়। অবশেষে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৬:০৬ মিনিটে ইরাকের এই নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এরই সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে ইরাকের এক নায়ক তন্ত্র শাসনব্যবস্থার এবং মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতার।

সাদ্দামের বিচার

২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়ার পরে ২০০৫ সালের অক্টোবরে তার বিচারকার্য শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনোনীত অন্তর্বর্তী সরকার নামক এক পুতুল সরকারের অধীনে। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় এবং ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঈদের দিন। 

ফাসির মুহূর্তে শিয়া সমর্থিত ইরাকি জনগণ সাদ্দামকে গালাগালি করতে থাকেন। কালেমা পড়তে পড়তে সাদ্দাম হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। রায় হওয়ার খুব দ্রুত সময়ের ভিতর সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কুকৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মনোনীত ইরাকের নব গঠিত পুতুল সরকার শঙ্কা করেছিল যে ইরাকের সুন্নি সম্প্রদায় অথবা আরব বিশ্বের কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতে সাদ্দামের বিচারের পুনঃনিরীক্ষণ এর জন্য আবেদন যদি করে। 
আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসি কোনমতেই ঠেকানো যাবে না। সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসিতে আরব বিশ্বের অনেক নেতাই ক্ষোভ এবং দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ফাঁসি কার্যকরের পর সাদ্দাম হোসেনের মৃতদেহ ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকীর বাড়ির সামনে ফেলে রাখা হয়। পরে তিনি সাদ্দামের জন্মস্থান তিকরিত এর বাসিন্দাদের কাছে সাদ্দামের মরদেহ হস্তান্তর করেন এবং ইসলামিক রীতি-নীতিতে তার দাফন কার্য সম্পন্ন হয়।

ইরাকের পরিস্থিতি যেমন ছিল সাদ্দামের পতনের পর

সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শিয়া এবং সুন্নি গোষ্ঠীদের ভেতর দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। আবার সাদ্দাম হোসেনের দলীয় নীতির কারণে সুন্নি জনগোষ্ঠীরা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হতো। কারণ ইরাকের যেকোনো সরকারী চাকুরী এবং লেখাপড়ার সুবিধার জন্য বাথ পার্টির অনুসারী হওয়া জরুরি ছিল। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ছিল কুর্দী জনগোষ্ঠী। 

সাদ্দামের পতনের পরে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠী গুলির মধ্যে দাঙ্গা হামলা শুরু হয়, আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রকাশ্যে গোলাগুলি বোমা হামলা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগে আল-কায়েদা নতুন করে ইরাকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে। তবে কয়েক বছর পরে ইরাকের সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় আল কায়েদা কে পরাজিত করা সম্ভব হয়। 

মূলত যুক্তরাষ্ট্রুন্নিদের প্রভাবিত করেছিল আল কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। আল-কায়েদার পরাজিত হওয়ার পর সুন্নি সম্প্রদায় বিক্ষোভ শুরু করে এই বলে যে তাদের উপর অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে যেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরী আল মালিকী প্রত্যাখ্যান করে। ২০১১ সালের দিকে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরা ধীরে ধীরে ইরাক ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। 

সেই সময় আল-কায়েদা নতুন রূপে ইসলামিক স্টেট নামে পুনরায় আবির্ভাব হয় ইরাকের মাটিতে। এরপর পুনরায় ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় আইএস কে নির্মূল করা সম্ভব হয় দীর্ঘ চার বছর পর। কিন্তু ততদিনে সুন্নী অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্যমান ছিল। 
সুন্নি এলাকার এক মসজিদের শেখ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পূর্বের শাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ সাদ্দাম হোসেনের শাসন আমল ভালো ছিল এবং ইরাককে শাসন করার জন্য সাদ্দামের মত শাসকেরই প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন আমেরিকা যদিও ইরাককে স্বাধীন করার কথা বলে কিন্তু মূলত ইরাক ইরানের মতই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের যাতাকলে পিস্ট। 

২০০৩ সালের দিকে গোটা বিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে কুটকৌশলী আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করেছিল তখন সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও এখন এটা একদমই পরিষ্কার। ইরাকের মত একটি দেশের প্রতি এরকম অন্যায় অবিচার করে ধ্বংস করা না হলে ইরাক আজকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি উন্নত দেশে পরিণত হতো।

আত্মবিশ্লেষণ

সাদ্দাম হোসেন মধ্যপ্রাচ্যের এমন একজন মুসলিম শাসক ছিলেন যার নামের সাথে ইরাকের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে এক প্রতাপশালী শাসকের উত্থান এবং একই সাথে পরবর্তীতে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক পতন এবং আর্থিক ধ্বংসের নাম জড়িয়ে আছে। সাদ্দামের পতনের আগে ইরাকের যতটুকু সমৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছিল তার অধিকাংশ অবদান রয়েছে সাদ্দামের নেতৃত্বের। 

আবার আজকের যে ইরাক বর্তমানে একটি ধ্বংসস্তূপের রাষ্ট্র, সাদ্দাম পতনের প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি রাষ্ট্রটি। বর্তমান ইরাকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশেই সাদ্দামের একগুয়েমী এবং কর্তৃত্ব বিস্তারের মনোবাসনা দায়ী ছিল। এক হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে ইরাকের মত একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, এটি যেমন তার জন্য অনেক প্রশংসার দাবি রাখে ঠিক তেমনি তিনি ক্ষমতা পাওয়ার পরে নিজ দেশে তথা দেশের বাইরের বিশ্বে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারও করেছেন। 

বিশেষ করে নিজ দেশে কয়েক হাজার কুর্দি হত্যা, ইরান এবং কুয়েত যুদ্ধে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন সে বিষয়গুলোকে পুঁজি করেই তথাকথিত শান্তিপ্রিয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে শেষ পর্যন্ত তার পতন ঘটিয়েছে। হয়তোবা সাদ্দাম হোসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কুটকৌশল গুলো বুঝতে পারেননি। 

ইরানের সাথে যুদ্ধের সময় যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন তখন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দামকে সমর্থন দিয়েছিল, নিজ দেশে কুর্দি হত্যার সময় সেই একই অস্ত্র ব্যাবহারের বেলায় সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে। শিয়া সুন্নী বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ইরানের বিরুদ্ধে যখন উসকে দেওয়া হল সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীকে তখন সাদ্দামকে এই কুটকৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন জানালেও, কুয়েত আক্রমণ করার সময় তারা সম্পূর্ণ চেহারা পাল্টে ফেলে সাদ্দামের বিপরীতে অবস্থান নেয়। 

বিশ্ব রাজনীতিতে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় মধ্যপ্রাচ্যে মাতব্বর গিরি একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই করতে চাই এবং ইরাক তথা সাদ্দাম হোসেনকে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থেই সব সময় ব্যবহার করে গেছে কুটকৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দাম হোসেন গণহত্যা এবং বিভিন্ন যুদ্ধ বাঁধিয়ে আমেরিকাকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে সহায়তা করেছেন মাত্র। 

সাদ্দাম হোসেন তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করার পরে ইরাকের সমৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে। এতে দেশের ভেতরে এবং বাইরে আরব বিশ্বের কাছ থেকেও সাদ্দাম বেশ প্রশংসিত হতে শুরু করেন। এর পরবর্তীতে উনি তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান ইরাকের বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপরে। আর সেজন্য তিনি ইরান এবং কুয়েতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। 

গোটা বিশ্ব এখন জানে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যে প্রধান তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে দুটি অভিযোগ অর্থাৎ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার এবং আল-কায়েদা নামক সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে সাদ্দামের যোগ সাজোস রয়েছে - অগ্রহণযোগ্য এবং ভিত্তিহীন। মূলত আমেরিকা কখনোই চাইনি মধ্যপ্রাচ্যে সে ছাড়া আরও কেউ মোড়ল হিসেবে আবির্ভূত হোক। 

এই বিষয়টিকে আড়াল করে আমেরিকা সব সময় গোটা বিশ্বে প্রচার করে বেরিয়েছে সাদ্দাম হোসেন এবং তার ইরাক আমেরিকা সহ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। পরবর্তীতে আমেরিকার সিআইএ, এফবিএ এর মত তদন্তসংস্থা এ ধরনের অভিযোগের কোন ভিত্তি খুঁজে পাইনি। তার পুরো জীবনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে সাদ্দাম হোসেনকে যেমন “নায়ক” বলা যায় ঠিক তেমনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে উনি আবার "খলনায়কের" ভূমিকাও পালন করেছেন।


আরও পড়তে পারেন

নিজ দেশে কয়েক লক্ষ কুর্দি হত্যার জন্য সাদ্দাম হোসেনকে যদি অভিযুক্ত করা হয় এবং গণহত্যাকারী বলা হয় তাহলে অন্যায় ভাবে মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগ এনে সাদ্দাম হোসেন এবং ইরাকের মত একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ লক্ষ লোককে হত্যা করার পরেও সুবিধাবাদী স্বার্থপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে কেন “গণহত্যাকারী” বলা হবে না? 

সাদ্দাম হোসেন যে দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সেই একই দোষে দোষী সাব্যস্ত হবে না কেন আমেরিকার সাবেক কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ? নাইন ইলেভেন এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে সেই অজুহাত দেখিয়ে সাদ্দাম হোসেনের পতন এবং ইরাক ধ্বংস করা হয়। অন্যদিকে অন্যায় ভাবে মিথ্যা অজুহাতে পুরা একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়া- এটা তাহলে কত বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতে পারে? 

আমেরিকার সাবেক কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কি তাহলে ভদ্রেবশি আন্তর্জাতিক মানের সন্ত্রাসী নয়? তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে বুশ যা যা করেছে তা রীতিমত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ভেতরেই পড়ে। কুর্দিদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেন অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, এজন্য তার সাজা প্রাপ্য ছিল। তাহলে মিথ্যা অভিযোগে ইরাক হামলা করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করার পর বুশের কেন শাস্তি হবে না?

আসলে এই স্বার্থপর, সুবিধাভোগী এবং তথাকথিত শান্তিপ্রিয় আমেরিকা গোটা বিশ্বের উপর এমন ভাবে কর্তৃত্ব বিস্তার করেছে যে কোন রাষ্ট্রই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। আমেরিকা এবং তার মিত্র বাহিনীর মধ্যে এমন শক্তিশালী একটি ঐক্যমত্য রয়েছে যে তাদের বিরুদ্ধে আসলে কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। 

যে ঐক্যটা আরব দেশের নেতাদের মধ্যে একদমই অনুপস্থিত। সাদ্দামের কর্মকাণ্ডে বেশ কিছু জায়গায় আরব বিশ্বের নেতাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে এটা সত্য তবে নির্বিচারে অন্যায়ভাবে আমেরিকা যখন ইরাক হামলা করলো তখন মধ্যপ্রাচ্যের কোন মুসলিম নেতা এগিয়ে যায়নি। 

সেই প্রাচীনকাল থেকেই আরব বিশ্ব নেতাদের মধ্যে কোন ঐক্য নেই। তার ফলাফল ২০২৪ সাল পর্যন্ত মুসলিমরা অবহেলিত নির্যাতিত তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল বর্তমানের ইজরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের উপর বর্বর ইসরাইলিদের অমানুষিক অত্যাচার।

উপসংহার

পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই কোন একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার তন্ত্র স্থায়ী হয়নি। সাদ্দাম হোসেনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি রাজনীতিতে যোগদান করার পর থেকেই দেশে এক দলীয়করণ নীতি চালু করেন এবং তার ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি দেশের বিরোধী দল এবং বিদেশী শক্তিকে সর্বদা দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। 
তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন অন্যায় অত্যাচার করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিলেন তবে তার সাথে এটাও ঠিক বিভিন্ন কূটনৈতিক এবং নীতিগত সিদ্ধান্তে কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন যার খেসারত দিতে হয় নিজের জীবন দিয়ে। ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার কারণেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি এত করুন না হয়ে সম্মানজনকভাবেও হতে পারতো।

আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ নিজের মতো করে সহজ ভাবে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। কতটুকু ভালো লাগলো সেটা কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন। আর ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো থাকবেন ধন্যবাদ। পরবর্তীতে অন্য কোন লেখায় আপনাদের সাথে যোগাযোগ হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url