ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম কী | যে কারণে পালিত হয় ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম


ফাতিহা ই ইয়াজদাহম ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিনে এই দিবসটি ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে পালন করা হয়। তবে ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম কী এবং কি কারণে পালন করা হয় সে ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। একজন মুসলিম হিসেবে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম এর ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই জানা উচিত।
ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম কী  | যে কারণে পালিত হয় ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম

ইসলামিক তথ্য এর আজকের এই পর্বে আমরা ফাতেহা ই ইয়াজদাহম এর ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। জানব ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালনের বিধান, শিক্ষা, করনীয় এবং আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) সম্পর্কে। তো চলুন কথা না বাড়িয়ে জেনে নেই। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। 

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম কী এবং কেন?

“ইয়াজদাহম” একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ ১১। ফাতেহা ই ইয়াজদাহম এর পূর্ণ অর্থ হলো আরবি রবিউস সানি মাসের ১১তম দিন। হিজরী ৫৬১ সালের ১১ রবিউস সানি আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তারে মৃত্যুর দিনে তার জন্য দোয়া পাঠ করা অর্থাৎ সূরা ফাতেহা পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা এবং এই উদ্দেশ্যেই তার মৃত্যুর স্মরণে এই দিনটিকে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম হিসেবে পালন করা হয়। 

যে কারণে পালিত হয় ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম

হিজরী ৪৭০ সালে ইরানের জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.)। তবে পরবর্তীতে তিনি বাগদাদে আবু সাঈদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (রহ.) এর কাছে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি মারেফাতের জ্ঞান এবং খিলাফত অর্জন করেন। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর বাবার নাম আবু সালেহ মুসা এবং মায়ের নাম উম্মুল খায়ের ফাতেমা।  

তার বাবা ছিলেন আমাদের প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নাতি হাসান ইবনে আলির বংশধর এবং তার মা ছিলেন নবীজি (সা:) এর আরেক নাতি হোসেন এর বংশধর। আব্দুল কাদের জিলানী রহ এর নাম মুসলিম বিশ্বের প্রত্যেকটি মুসলিমের কাছে অত্যন্ত সম্মানের এবং শ্রদ্ধার। আব্দুল কাদির রহঃ এর জীবনী এবং তার কর্মকাণ্ড মুসলমানদের হৃদয়ে চিরদিন জীবন্ত হয়ে থাকবে। 
আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) হাম্বলি এবং সুন্নি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। মহান আল্লাহর একজন ওলী হিসেবে বিশ্বজোড়া তার পরিচিতি ছিল। আরবি সাহিত্য এবং হাদিসে তার পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন, কাব্য, ভূগোল বিষয়েও তার জ্ঞান ছিল সীমাহীন। এই বিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যার মধ্যে “গুনিয়াতুত তালেবীন”, “আল ফাতহুর রাব্বানী” উল্লেখযোগ্য। 

আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) ছিলেন ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মনেতা। তার এই গৌরবময় জীবনের বীরত্বপূর্ণ কীর্তিগাথার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় এখনো তার এই মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করে রাখার এবং শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যেই ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন করে থাকে।

ইসলামে আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর অবদান

গোটা মুসলিম বিশ্বের কাছে আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) ছিলেন একজন আদর্শ নেতা। তার নাম প্রত্যেকটা মুসলমানের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার। আজ পৃথিবী জুড়ে যতটা মুসলিমদের মধ্যে ধার্মিকতা দেখা যায় তার অনেকাংশেই অবদান রয়েছে এই বড় নেতার। সৃষ্টির পরে থেকেই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ পাক কয়েক লক্ষ নবী রাসুল পয়গম্বর প্রেরণ করেছেন। 

কিন্তু দরবেশ, ফকির, অলি, পীর পৃথিবীতে কতজন ছিল তার কোন হিসাব নেই সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। অথচ এই অসংখ্য পীর, দরবেশ, অলি আউলিয়া, ফকির এর মাঝে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) ছিলেন অন্যতম এবং সেরা। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের প্রায় ৫০০ বছর পর পৃথিবীতে আসেন অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:)। 
তিনি এমন এক সময় পৃথিবীতে আসেন যখন পৃথিবীর মানুষ আল্লাহ এবং রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নীতি এবং আদর্শ ভুলে বিপথগামী হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে মানুষ আল্লাহর ইবাদত না করে বিভিন্ন মূর্তি পূজা করত। মুনাফিকি, কাফেরি শিরক এসব নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ইসলামের এমন একটি নাজুক অবস্থায় আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) নিয়মিত মানুষদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। 

তার দাওয়াতে অনেক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ইসলামের ইতিহাসে এবং ইসলাম রক্ষার্থে তার এই অবদানের কথা মুসলিম বিশ্বের কোন মুসলমান ভুলতে পারবে না। ইসলামের প্রতি তার এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে।

ফাতেহা ই ইয়াজদাহম কত তারিখ

হিজরী সনের হিসাব অনুযায়ী রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালিত হয়ে থাকে। সেই অনুসারে এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ হচ্ছে আরবি রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৫ই অক্টোবর পালিত হবে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম।

ফাতেহা ই ইয়াজদাহম কি সরকারি ছুটি?

ইসলামের ইতিহাসে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর অবদান অনস্বীকার্য। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন পৃথিবীর মুসলিম সম্প্রদায় আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) কে স্মরণ করবে তার অবদানের জন্য। তার এই অবদানকে এবং তাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্যই ফাতেহা ই ইয়াজদাহম অর্থাৎ হিজরি সালের রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ বাংলাদেশে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

ফাতেহা ই ইয়াজদহম পালনের সঠিক বিধান কি

আমরা ইতিপূর্বে জেনে গেছি ইসলামের প্রতি বিশেষ অবদানের কারণেই হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর ইন্তেকাল এর দিনটিকে স্মরণীয় রাখার উদ্দেশ্যে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন করা হয়। তবে বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরাম ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন করাকে জায়েজ মনে করেন না। কারণ ইসলাম কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন করার অনুমতি দেয় না। 
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) অবশ্যই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন তবে তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন নবী রাসূলগণেরা। তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস আমরা কখনো পালন করি না। অথবা ইসলামে কখনো তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন করার ইতিহাস নেই কিংবা নবী রাসূলগণ নিজেরাই কখনো তাদের অনুসারীদের আদেশ দিয়ে যাননি যে তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন করার জন্য।

ফাতেহা ই ইয়াজদাহমে করণীয়

বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামের মতে ঘটা করে এই দিবসটি পালন করা জায়েজ নয় অর্থাৎ ইসলাম সম্মত নয়। যেটি ইসলাম সম্মত নয় সেটি জোরপূর্বক পালন করা হচ্ছে বিদআত এবং বিদআত হচ্ছে একটি বড় গুনাহ যা ইসলাম পরিপন্থী কাজ। তাই হযরত আব্দুল কাদির জিলানী এর মৃত্যু দিবস কে উদ্দেশ্য করে পালন না করে বরং তার জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে যেন সাধারণ মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। 

এই দিনসহ অন্য যে কোন দিনে আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) সহ পুরা মুসলিম বিশ্বের মুসলমানদের জন্য দোয়া মোনাজাত করা যেতে পারে। ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালনের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ এবং বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন- কুরআন এবং সুন্নাহ মতে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন জায়েজ নয়। তবে আব্দুল কাদের জিলানী যেহেতু মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত সম্মানজনক একজন ব্যক্তি তাই তার জন্য দোয়া, মোনাজাত করা যেতে পারে।

ফাতেহা ই ইয়াজদাহম থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই

অনেক ইসলামিক পন্ডিত এবং ওলামা কেরামের মতে ঘটা করে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন না করে বরং এই দিবসটি যে ব্যক্তির কারণে এসেছে তার জীবন দর্শন থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক। তার সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত শিক্ষনীয় গল্প জানলে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারব। 

হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) একবার ইরাকের বাগদাদে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন, তার মা তার জামার পকেটে ৪০ টি স্বর্ণ মুদ্রা রেখে দেন যেন তার কোন রকমের অর্থ কষ্ট না হয়। তার মা তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি যেন কোন অবস্থাতেই মিথ্যা কথা না বলেন। 

পথিমধ্যে ডাকাত আক্রমণ করলে সকল লোকের কাছে সবকিছু নেওয়া শেষে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর কাছে ডাকাত দল এসে তার কাছে কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি অকপটে সত্য কথা বলেন যে তার মা তাকে চল্লিশটি স্বর্ণ মুদ্রা দিয়েছেন এবং তার কাছে সেগুলো আছে। প্রথমে ডাকাত দল তার কথা বিশ্বাস করতে চাইনি। 
কারো কাছে টাকা পয়সা ধন সম্পদ থাকার পরে কেউ এভাবে সত্য কথা বলতে পারে? কিন্তু যখন ডাকাত দল স্বচক্ষে স্বর্ণ মুদ্রা গুলো দেখতে পেল তখন হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর (রহ.) সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে তওবা করে তারা ডাকাতির মত ঘৃন্য কাজ থেকে সরে এসে দ্বীনের কাজ করা শুরু করেছিল। এভাবে তিনি আমাদের জন্য সত্যবাদিতার শিক্ষা রেখে গেছেন এবং এভাবেই তিনি সমাজ সংস্কার করেছিলেন যেভাবে তিনি ডাকাতদের কে ডাকাতি করা থেকে দূরে সরিয়ে ভালো কাজে মনোনিবেশ করিয়েছিলেন।

উপসংহার

মুসলিম হিসেবে আমরা অনেক আবেগী আবেগের বসেই হয়ত না জেনে ফাতেহা ই ইয়াজদাহম পালন করে থাকি কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এ দিবসটি পালনের কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় এটি পালন করা বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে। বরং এ দিবসটি পালন না করে এই দিনটি থেকে অর্থাৎ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারি আমরা। 

যেমন উনি ইসলামের জন্য কতটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, মানুষকে কিভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইসলামের পথে নিয়ে এসেছেন, উনি মানুষ হিসেবে কতটা সৎ এবং সত্যবাদী ছিলেন ইত্যাদি বিষয়ে আমরা তার কাছ থেকে শিখতে পারি, তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারি।

আজ এ পর্যন্তই। আশা করি ফাতেহা ই ইয়াজদাহম এর ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। পরবর্তীতে নতুন কোন বিষয়ে নতুন কোন লেখায় আপনাদের সাথে যোগাযোগ হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আর লেখাটি ভালো লেগে থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url