সাদ্দাম হোসেন | ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন যুদ্ধ এবং গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক | পর্ব ০২
“বিশ্ব ব্যক্তিত্ব” এর অন্তর্ভুক্ত ‘সাদ্দাম হোসেন’ এর দ্বিতীয় পর্বে আপনাদের সকলকে স্বাগতম। এই পর্বে আমরা জানব সাদ্দাম হোসেন সবচেয়ে বেশি যে কারণে সমালোচিত হন। অর্থাৎ ইরান, কুয়েত এর সাথে যুদ্ধ এবং কুর্দিদের উপর যে গণহত্যা চালিয়েছেন তার কারণ, প্রেক্ষাপট এই সব বিষয়ে আমরা জানার চেষ্টা করব।
তো চলুন জেনে নেই বিষয়গুলো। আশা করি অনেক তথ্য জানতে পারবেন এবং পড়তে ভালো লাগবে। এই সিরিজের প্রথম পর্ব না পড়ে থাকলে এবং পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
কুর্দিদের গনহত্যা
ইরাকে শিয়া, সুন্নি, কুর্দি সহ আরো বেশ কিছু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল তবে সুন্নী ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। সাদ্দাম হোসেন রাজনৈতিকভাবে বাথ পার্টির অনুসারী এবং ধর্মীয় ভাবে সুন্নী বিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন। তাই স্বভাবতই কুর্দি এবং শিয়া দের তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। শক্ত হাতে ইরাক শাসনের যে সুনাম রয়েছে এর পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে অনেক।
এই অভিযোগ করেছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দামের চিরশত্রু শিয়া এবং কুর্দিদের দমনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ রয়েছে সাদ্দামের বিরুদ্ধে। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক হামলা চালিয়ে প্রায় এক লক্ষ কুর্দিকে হত্যা করা হয় যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক লোক।
এই হত্যাকাণ্ডকে বলা হয় “আল আনফাল অপারেশন”। এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয় কেমিকেল ওয়েপন বা রাসায়নিক অস্ত্র যেগুলোকে বলা হয় মূলত Weapon of Mass Destruction । এ অস্ত্র ব্যবহারের বিশেষত্ব হল অবকাঠামো, দালান সবকিছু থাকবে শুধুমাত্র মানুষ মারা যাবে। পরবর্তীতে আবার ১৯৮৮ সালের ১৬ মার্চ কুর্দি হিসেবে পরিচিত হালাবজাতে গ্রামে হামলা চালিয়ে একসাথে প্রায় ৬ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
এর আগে ১৯৮২ সালে শিয়াদের এক গ্রামে হামলা চালিয়ে একসাথে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এক সফরে শিয়ারা সাদ্দামকে হত্যার চেষ্টা করে এবং এর প্রতিশোধ হিসেবে তিনি এই আক্রমণ চালান।
ইরাক ইরান যুদ্ধ
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর এবং রক্তক্ষয়ী ছিল ইরাক ইরান যুদ্ধ। সাবেক মার্কিন স্টেট সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জার যুদ্ধ চলাকালীন মন্তব্য করেছিলেন “ইরাক ইরান যুদ্ধ পৃথিবীর একমাত্র যুদ্ধ যেখানে দুই পক্ষই পরাজিত হবে।” যুদ্ধ শেষে দেখা যায় তার এ ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।
তবে যুদ্ধের আগে ইরান ইরাকের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৩২ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই “সাত-ইল আরব” নামের একটি জলপ্রণালী কে ঘিরে ইরান ইরাকের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রিস নদীর পানি ইরাকের ভেতর দিয়ে পারস্য উপসাগরে গিয়ে পৌঁছায় অপরদিকে পারস্য উপসাগরে জাহাজ যেতে চাইলে ইরানকেও সাত ইল আরবের উপর দিয়েই যেতে হতো।
তাই দুটি রাষ্ট্রের জন্যই এই এলাকাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরাক এবং ইরান উভয়ে দাবি করে সাত ইল আরব তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে লেগে থাকা দ্বন্দ্ব নিরসনে ১৯৩৭ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইরান সাত ইল আরব ব্যবহারের জন্য ইরাককে কিছু টোল প্রদান করত।
ইরানের সামরিক শক্তি অত্যন্ত দুর্বল থাকায় তখন এই চুক্তি তাদের মানতে বাধ্য করেছিল। এভাবে বেশ কয়েক বছর চলতে থাকে। পরবর্তীতে কালক্রমে ইরানের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক শক্তির বেশ উন্নতি হয়। রেজা সাহ পাহলভীর শাসনামলে ইরানের সামরিক শক্তি এতটাই উন্নতি হয় যে ইরাকের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে।
তাই ইরান এই সুযোগ কে কাজে লাগায় এবং ১৯৩৭ সালের চুক্তি বাতিল করার অংশ হিসেবে টোল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। শুরু হয়ে যায় আবারো পুরনো দ্বন্দ্ব। ইরাক নানাভাবে ইরানকে হুমকি দিতে থাকলেও ইরানের সামরিক শক্তির ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় সহজেই যুদ্ধে জড়াতে পারেনি ইরাক। এরপর ১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি চুক্তিতে সম্মত হয় ইরাক ও ইরান।
এই চুক্তি অনুযায়ী সাত ইল আরবকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে রাজি হয় ইরাক বিনিময়ে ইরান ইরাকের মধ্যে থাকা শিয়া সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে কোনরকম সাহায্য সহযোগিতা করবে না। এই চুক্তি অনুযায়ী কয়েক বছর চলার পরে ১৯৭৯ সালে পরিস্থিতি আবার ঘোলাটে হতে শুরু করে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে শিয়া সমর্থিত জনগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে সরকার গঠিত হয় অন্যদিকে ইরাকে বাথ পার্টি সরকার গঠন করে এবং সাদ্দাম হোসেন হন রাষ্ট্রপতি।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই সাদ্দাম চেয়েছিলেন ইরানের সাথে পূর্বের সকল দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্য করেছিলেন। তবে ইরানের তৎকালীন সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লা রুহুল্লাহ খমেনি সাদ্দাম হোসেনের সাথে কোন রকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন না করে বরং ইরাকের অভ্যন্তরে থাকা কুর্দি এবং শিয়া সম্প্রদায়কে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা শুরু করে।
সাদ্দাম হোসেন এবং তার বাথ পার্টি সুন্নী সমর্থিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আবার ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের প্রভাব ইরাকেও পড়তে শুরু করে। একদিকে ইসলামিক বিপ্লবের প্রভাব অন্যদিকে ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া সুন্নির অন্তর্দন্দ সব মিলিয়ে সাদ্দাম হোসেন ইচ্ছা থাকলেও ইরানের সাথে আর সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেন এসব সমস্যার সমাধান যুদ্ধের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন। তাই সাদ্দাম হোসেনের নির্দেশনায় ইরাক ইরানকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ওদিকে ইরাক যে ইরানকে আক্রমণ করতে পারে এটা ইরান আন্দাজ করেছিল। তবে ইরাক সরাসরি প্রথমে ইরানের ভূখণ্ডে আক্রমণ না করে বরং সীমান্তবর্তী স্থান খুজিস্থানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই স্থানের অধিকাংশ জনগণ ছিল সুন্নি মতাদর্শের। ইরান যেমন ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া সম্প্রদায় কে সাহায্য সহযোগিতা করত সাদ্দামও চেয়েছিল ইরানের অভ্যন্তরে খুজিস্থানের সুন্নি জনগণকে উসকে দিতে। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮০ সালে ইরাক ইরানে আক্রমণ শুরু করে। ইরাক সামরিক শক্তিতে এগিয়ে থাকলেও ইরানের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় বহু সংখ্যক নওজোয়ান যারা আত্মঘাতী শক্তিতে বলিয়ান ছিল অর্থাৎ মৃত্যুকে ভয় করত না।
এদিকে আরব বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো ইরাকের পক্ষ নেয় কারণ তাদের ধারণা ছিল ইরান যদি এই যুদ্ধে জয়লাভ করে তবে পুরো আরব বিশ্বে ইসলামী বিপ্লব ছড়িয়ে পড়তে পারে যেটি মূলত ছিল শিয়া মতাদর্শের। আরব বিশ্বের মধ্যে মিশর গোপনে সোভিয়েত সমরাস্ত্র যোগান দেয় ইরাক কে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম দিকে চুপ থাকলেও অত্যন্ত গোপনে ইরাক এবং ইরানকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের যোগান দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে।
এই যুদ্ধের সময়ে কখনো ইরাক এগিয়ে থাকতো কখনো ইরানে এগিয়ে থাকতো। এইভাবে বহুবার আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলেছে। ইরাক ইরানের ভেতরে বেশ কিছু জায়গার দখল এবং উদ্ধার চলতে থাকে। আরব বিশ্বের কিছু রাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্রের যোগানের কারণে ইরাক ইরান যুদ্ধ দীর্ঘ আট বছর স্থায়ী হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় ইরান ইরাক যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দুই দেশেই কেবলমাত্র ধ্বংসস্তূপ আর হত্যাযজ্ঞ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। দীর্ঘ আট বছরে ইরান এবং ইরাক দুই দেশই পারস্য মহাসাগরে একে অপরের তেলবাহী জাহাজে আক্রমণ চালায়, ইরান ইরাকের পরমাণু প্রকল্পে হামলা করে একইভাবে ইরাক ইরানকে ধ্বংস করতে কেমিক্যাল বোমা নিক্ষেপ করে।
এসব কারণে দুই দেশেই ধ্বংসের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। অর্থনৈতিকভাবে দুই রাষ্ট্রই একদম নাজেহাল হয়ে যায়। ইরাক যেমন ইরানের খুজিস্থান প্রদেশ দখল করতে পারেনি তেমনি ইরানও ইরাকের সরকারে সিয়া মতাদর্শের কোন ব্যক্তিকে বসাতে পারেনি। যুদ্ধ শেষে ইরান ইরাকের অর্জন একদম শূন্য হলেও আরব বিশ্ব এবং পশ্চিমা বিশ্ব হাততালি দিয়ে মজা নিয়েছে এবং অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা করে লাভবান হয়েছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী ইরান ইরাক পরাজিত হয় আর জয় লাভ করে আরব বিশ্ব তথা পশ্চিমা বিশ্ব। ইরান ইরাক যুদ্ধে দুই রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বা তারও বেশি এবং প্রাণহানি ঘটে প্রায় ২০ লক্ষের মতো যা প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সর্বোচ্চ ভয়ংকর ক্ষতির ইতিহাস সৃষ্টি করে।
উপসাগরীয় যুদ্ধ
এই যুদ্ধ ইরাক কুয়েত যুদ্ধ, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ, পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ নামেও পরিচিত। ১৯৯০ সালের ২রা আগস্ট ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন তার সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেন কুয়েত দখল করার জন্য। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাদ্দাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দখল করতে চেয়েছেন কিন্তু ইরাক হামলার পেছনে রয়েছে কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ।
মূল কারণ হলো ইরান ইরান যুদ্ধ। দীর্ঘ আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের কারণে ইরান ইরাক দুই দেশই আর্থিকভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। সে যুদ্ধে অর্থ যোগানদাতা হিসেবে ছোট্ট দেশ কুয়েত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কুয়েতের কাছে সাদ্দামের ঋণ হয়েছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এদিকে যুদ্ধের কারণে ইরাক এবং ইরান উভয় দেশেরই তেল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ চাপের মুখে পড়ে। ফলে তেল সরবরাহের জন্য অন্যান্য আরব দেশ অর্থাৎ কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার, লিবিয়া প্রভৃতি দেশ এর উপর চাপ পড়ে। গোটা বিশ্বের সঠিকভাবে তেল যোগান দেওয়ার জন্য এই দেশগুলো যে পরিমাণ তেল উত্তোলন করত তার চাইতে বেশি উৎপাদন করার প্রয়োজন পড়লো।
আর বেশি উৎপাদন কারণে তেলের দরপতন শুরু হল। তবে ইরাকের জন্য সবচেয়ে বড় গলার কাটা ছিল কুয়েত। তেল রপ্তানি কারক দেশগুলোর সংগঠন Opec কুয়েতের জন্য একটি নির্দিষ্ট কোটা ঠিক করেছিল যার উপরে কুয়েত তেল উৎপাদন করতে পারবে না কিন্তু ওপেকের এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে কুয়েত তার জন্য বরাদ্দকৃত কোটার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ তেল উৎপাদন করত।
কারণ কুয়েত তখনো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি এবং তৎকালীন সময়ে আসন্ন বাজেটের জন্য তার অর্থের প্রয়োজন ছিল অনেক। তাই ইরাক এবং ওপেক বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও কুয়েত সে নির্দেশনা না মেনে অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করায় তেলের দরপতন হয়। ইরান ইরাক যুদ্ধের আগে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ২০ ডলার আর যুদ্ধ শেষে সে দাম নেমে আসে ১০ ডলারের নিচে।
সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশ দাম বাড়ানোর পক্ষে ছিল এবং তারা প্রতি ব্যারেল তেল ১৮ ডলার করার প্রস্তাব রাখে যেখানে ইরাক প্রস্তাব দেয় ২২ ডলার। সেই সময়ে বৈদেশিক প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা নিয়ে দিশেহারা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। তার মাথার উপরে একদিকে যেমন ঋণ পরিশোধের বোঝা অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বোঝা।
তিনি চেয়েছিলেন তেল বিক্রি করে যে আয় হবে সেটা দিয়েই ইরাকের অর্থনীতিকে সচল করতে পারবেন। কিন্তু কুয়েতের এমন আচরণে সাদ্দাম আসলে তেমন কিছুই করতে পারছিলেন না কারণ তার দেশে তখন পর্যন্ত আর্থিক সমস্যার কারণে তেল উৎপাদন শুরু করতে পারেননি। কুয়েতের তৎকালীন আমিরকে সাদ্দাম ব্যক্তিগতভাবে চিঠি পাঠিয়ে ওপেকের কোটা মত তেল উৎপাদনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
এই অনুরোধের ভিত্তিতে কুয়েত কিছুদিন অপেক্ষা এর নির্ধারিত কোটা মেনে তেল উৎপাদন করলেও পরবর্তীতে তা আর মানা হয়নি। এরপর ১৯৯০ সালের মার্চ মাসের দিকে সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করে বলেন ইরাককে কোণঠাসা করতে কুয়েত এমন আচরণ করছে। আরব বিশ্ব গুলোকে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইরানের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাকের প্রায় ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে অথচ আজকে তার বিপদের দিনে আরব দেশগুলো তার সাথে সহযোগিতা পূর্ণ আচরণ করছে না।
এরপরে অবশ্য আরব আমিরাত ইরাকের অনুরোধ এবং অভিযোগের ভিত্তিতে ওপেক কোটা মানলেও কুয়েত তার নিজস্ব স্থানে অনড় থাকে। সকল প্রচেষ্টা এবং অনুরোধ ব্যর্থ হওয়ায় ইরাকের এবং কুয়েতের সীমান্তবর্তী এলাকা শুধু ওয়ারবায়ার এবং বুবিয়ান অঞ্চল দুটি (এ দুটি অঞ্চল নিয়ে ইরাক বহু বছর আগে থেকেই নিজের দেশেরই দুটি প্রদেশ দাবি করে আসছিল এবং এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে মনমালিন্য ও দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল) নয় বরং পুরো কুয়েতই ইরাকের দখলে চাইলেন সাদ্দাম হোসেন।
১৯৯০ সালের দোসরা আগস্ট সাদ্দাম হোসেন তার সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেন কুয়েত দখল করার জন্য। সাদ্দাম হোসেন এটাও ভেবেছিলেন কুয়েতকে সাহায্য করার মত আরব বিশ্বে কেউ নেই আর আরব বিশ্ব কখনোই বিদেশি সেনাবাহিনীকে গ্রাহ্য করবে না। কিন্তু তার এ ধারণা খুব শীঘ্রই ভুল প্রমাণিত করে মার্কিন বাহিনী তাদের সেনা পাঠায় কুয়েত উদ্ধার করতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক ছিল সে সময় বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। কুয়েত দখলের পর ইরাক বাহিনী কুয়েতে অবস্থিত সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রের খুব কাছাকাছি চলে যায়। এতে সৌদি আরব ভীষণ উদ্বিগ্ন হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতায় যৌথ বাহিনীর প্রেরণ করে উদ্ধারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা করেছিল যে ইরাক যদি কুয়েত সৌদি আরবের তেল ক্ষেত্রগুলো দখল করে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তবে সাদ্দাম হোসেন পুরো বিশ্বের অধিকাংশ তেলের মালিক হবে এবং আরব বিশ্ব সহ মধ্যপ্রাচ্যেও সাদ্দাম হোসেনের একটি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল শুধুমাত্র ইরাক এবং অন্যদিকে ছিল জাতিসংঘ সমর্থিত ৩৯ টি রাষ্ট্রের যৌথ বাহিনী যার মধ্যে বাংলাদেশেরও বেশ কিছু সেনাবাহিনী ছিল।
সেই সময়ে কুয়েতের সেনাবাহিনী ছিল মাত্র ১৬ হাজারের মতো অপরদিকে ইরাকের সেনাবাহিনী ছিল প্রায় দশ লাখের মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে কুয়েত উদ্ধারের এ যুদ্ধের নাম দিয়েছিল “অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড।” অবশেষে ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোটের অপপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে ইরাকিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে উপসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিছু অর্জন না করেই ইরাকি সেনাবাহিনী নিজ দেশে ফেরত যায়।
সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ ছিল
সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মূলত তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছিল যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। প্রথম অভিযোগ ছিল সাদ্দাম হোসেনের সরকার রাসায়নিক, জৈবিক ও পারমাণবিক অস্ত্র সহ ব্যাপক জনবিধ্বংসী অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুদ, উৎপাদন ও সংরক্ষণ করছে। দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল সাদ্দাম হোসেন প্রায় পাঁচ লক্ষ কুর্দিকে নির্বিচারে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছে।
দ্বিতীয় কারণ তৃতীয় অভিযোগ ছিল ১৯৯১ সালের সংঘটিত টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পেছনে সাদ্দাম হোসেনের হাত ছিল। শুধু দ্বিতীয় কারণ ছাড়া বাকি দুটি কারণে ছিল মূলত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যা পরবর্তীতে প্রমাণ হয়। অর্থাৎ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পেছনে সাদ্দাম হোসেনের যোগসাজোস এর কোন তথ্য গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে পায়নি এবং পুরো ইরাক জুড়ে কোন বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ বা উৎপাদন হওয়ার কোন তথ্য এফবিআই, সিআইএ এর মত প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাইনি।
এর পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে জোর করে ইরাকের উপর দোষ চাপাতে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র পরিদর্শকের একটি টিম ইরাকে পাঠায় এবং এরপরে নতুন করে ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে সাদ্দাম হোসেনের সরকার অস্ত্র পরিদর্শদের কোনভাবেই সহযোগিতা করছেন না বরং তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। তবে সাদ্দাম হোসেন তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন এবং তিনি মিডিয়ার সামনে বলেন অস্ত্র পরিদর্শনের নামে তারা আসলে গুপ্তচর বৃত্তি করছে। পরবর্তীতে সাদ্দাম হোসেনের এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়।
মন্তব্য
সাদ্দাম হোসেন তার ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে চাইতেন। তিনি চেয়েছিলেন ইরাকে যেন শুধুমাত্র সুন্নি মতাদর্শের লোকজনই থাকে তাই তিনি ইসলামী বিপ্লব এড়ানোর জন্য শিয়া কুর্দিদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন। দেশের বাইরেও তিনি তার প্রভাব বিস্তার করার জন্য উৎসাহী ছিলেন। তার ফলশ্রুতিতেই তিনি ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়ান এবং কুয়েত দখল করেন।
‘সাদ্দাম হোসেন’ সম্পর্কে তৃতীয় পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। এই লেখাটি ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url