মোবাইল ফোনে কথা বলার আদব | জেনে নিন ১৩ টি শিষ্টাচার
বর্তমানে ডিজিটাল যুগে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম সেরা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। মানুষের হাতে হাতে থাকা এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সব ধরনের যোগাযোগ করা সম্ভব। পারস্পারিক যোগাযোগ কেনাকাটা ব্যবসা বাণিজ্য পড়ালেখা সহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন পূরণ করছে এই মোবাইল ফোন। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই মোবাইল ফোনের মূল কাজ হল মানুষের সাথে যোগাযোগ করা অর্থাৎ কথা বলা।
আর মোবাইল ফোনে এই কথা বলার জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার যা সামাজিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুঃখের বিষয় হলো আমরা আধুনিক সমাজে বাস করার পরেও অনেকেই মোবাইল ফোনে কথা বলার আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা।
স্মার্টফোনের আজকের এই পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করব মোবাইল ফোনে কথা বলার কি কি নিয়ম নীতি রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে আমাদের কথা বলার কারণে অপর প্রান্তের ব্যক্তিদের যেন কোন ক্ষতি সাধন না হয়। তো চলুন জেনে নেয়া যাক মোবাইলে কথা বলার আদব কায়দা গুলো।
কুশলাদি বিনিময় করুন
যিনি কল করেছেন এবং যিনি ফোন রিসিভ করবেন উভয়ের ক্ষেত্রেই কথার শুরুতেই কুশল বিনিময় করা ভদ্রতা। মুসলিমদের জন্য হ্যালো বলার পরেও সালাম দেওয়া উচিত এবং সালাম টা দিতে হবে একদম সহীহ শুদ্ধ ভাবে “আসসালামু আলাইকুম”। সালামের জবাবও হবে সহি-শুদ্ধভাবে “ওয়া আলাইকুমুস সালাম”। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তাদের নিজের ধর্মের কুশলের রীতি মেনে চলা উচিত।
অপেক্ষা করুন
আপনি কাউকে আপনার প্রয়োজনে ফোন দিয়েছেন কিন্তু সেই ব্যক্তিটি কোন কারনে ফোন রিসিভ করতে পারে না। পুনরায় আর একবার ফোন দিবেন তারপরও যদি রিসিভ না করে তবে কমপক্ষে এক ঘন্টা অপেক্ষা করুন। প্রয়োজনে এই সময়ের ভেতর একটি মেসেজ দিয়ে রাখতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ মোজার দুর্গন্ধ থেকে চির মুক্তি
অর্থাৎ দুইবার ফোন দেওয়ার পরে রিসিভ না করলে অপেক্ষা করুন এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার একবার ফোন দিন। অনেকে আছেন ফোন রিসিভ না করা পর্যন্ত অনবরত ফোন দিতেই থাকেন এটি চরম অভদ্রতা। রিসিভ কারি বিশেষ কোনো কারণে ফোন ধরতে পারছেন না এটি আপনাকে বুঝতে হবে।
নিজের পরিচয় দিন
ফোন কারি এবং ফোন রিসিভ কারি উভয়ের মধ্যে জানাশোনা নেই কিন্তু ফোন কারি তার নিজের প্রয়োজনে ফোন রিসিভ কারীর নাম্বার সংগ্রহ করে তাকে ফোন দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই কথার শুরুতেই ফোনকারী তার নিজের পরিচয় প্রদান করবেন রিসিভ কারিকে। এরপর তাকে ফোন দেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবেন। এটি ফোনে কথা বলার একটি ভদ্রতা।
ভুল নম্বর থেকে ফোন এলে শান্ত থাকুন
প্রায়ই সময়ে আমাদের সকলের ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করা হলে কথা বলে বুঝতে পারি সেটা আননোন নাম্বার। এক্ষেত্রে শান্ত হয়ে তার নাম্বারটি যে ভুল সেটি তাকে বুঝিয়ে বলুন। মানুষের ভুল হতেই পারে। তবে পরবর্তীতে যদি আপনি বুঝতে পারেন সে ব্যক্তিটি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাকে উত্ত্যক্ত করার জন্য বারবার এইভাবে ফোন দিচ্ছে তবে প্রথমে তাকে সাবধান করুন এবং এতে কাজ না হলে আইনের আশ্রয় নিন।
ফোন দেয়ার আগে ভেবে দেখুন
আপনি যাকে ফোন দিচ্ছেন তিনি অসুস্থ কিনা অথবা তিনি ব্যস্ত থাকার কথা কিনা সেই সময়ে ফোন দেওয়ার আগে সেটা একবার ভেবে দেখুন। ব্যক্তিকে যদি বয়স্ক হয় এবং তিনি যদি বাসা দিয়ে থাকেন তবে দুপুর তিনটার সময় ফোন দেওয়ার আগে ভাববেন তিনি কি এ সময় ঘুমাতে পারেন কিনা!
অথবা ঠিক মাগরিবের সময়ে কাউকে ফোন দেওয়ার আগে অবশ্যই ভাববেন এই সময় তিনি নামাজে থাকতে পারেন কিনা। আপনার যদি খুব জরুরী ফোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে এবং রিসিভ কারী ব্যক্তি ফোন ধরে যদি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে তবে ভদ্রতার সহিত জেনে নিবেন পরবর্তীতে তাকে কোন সময় ফোন দেয়া যাবে।
মিথ্যা বা গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন
এমন একটি খবর আপনি শুনলেন যেটি যাচাই করার অথবা সত্যতা প্রমাণের কোন সুযোগ নেই এমন খবর অবশ্যই কাওকে ফোন করে জানাবেন না। ধরুন আপনার চাচাতো ভাই বিদেশে কর্মরত অবস্থায় আছেন। আপনি একটা গুজব খবর পেলেন যে সেখানে বেশ কিছু লোক সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়েছেন।
এই খবরটির আপনি সত্যতা যাচাই না করে আপনার চাচাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন। এতে কি হবে- আপনার চাচা বয়স্ক ব্যক্তি হওয়ায় তার টেনশনে হাই প্রেসার উঠে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন এমনকি তার মৃত্যু ঝুঁকিও হতে পারে।
কথা শেষ হলে কল কাটুন
এমন অনেক কলকারী ব্যক্তি রয়েছেন যারা কাওকে কল করার সময় ফোনের ক্যানসেল বাটনে আঙ্গুলের প্রস্তুতি নিয়েই থাকেন। অপর প্রান্তের ব্যাক্তি কথা বলা পরিপূর্ণভাবে শেষ না হতেই তিনি কল কেটে দেন। নিজের পরিবারের অথবা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিষয়টি তেমন কিছু না হলেও ফরমাল পরিবেশে বা আত্মীয় স্বজনের ক্ষেত্রে বিষয়টি অভদ্রতার শামিল। কলকারী ব্যক্তি কথা শেষে যদি সালাম দিয়ে থাকেন তবে অপর প্রান্তের ব্যক্তিটির সালামের জবাব শোনার পরেই কল কাটা উচিত।
কল ব্যাক করে কথা বলুন
কলকারী ব্যক্তি কাউকে কল দেওয়ার পরে রিসিভ কারি ব্যক্তি যদি ফোন রিসিভ করতে না পারেন কিছুক্ষণ পরে হয়তো সেই ব্যক্তিটি কলকারী ব্যক্তি কে কল দিয়ে থাকেন। এই ক্ষেত্রে কলকারী ব্যক্তির উচিত হবে কলটি রিসিভ না করে অথবা কলটি কেটে দিয়ে কল ব্যাক করে অপর প্রান্তের ব্যক্তির সাথে কথা বলা। কারণ প্রয়োজন হলো কলকারী ব্যক্তির তাই তারই উচিত টাকা খরচ করে অপর প্রান্তের ব্যক্তির সাথে তার প্রয়োজন সেরে ফেলা। এটি একটি সৌজন্য ভদ্রতা।
পাবলিক প্লেসে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলুন
হাটে বাজারে বাসে বা ট্রেনে এমন অনেক ব্যক্তি পাওয়া যাবে যিনি কথা বলার সময় ভুলে যান তিনি বাইরে আছেন। এত উচ্চ শব্দে কথা বলেন যে আশেপাশের মানুষজন পর্যন্ত তার কথা বলার কারণে বিরক্ত বোধ করেন। আবার বাসে ট্রেনে যাওয়ার সময় এরকম ব্যক্তির কথা বলার কারণে পাশের সিটে বসে থাকা কোন অসুস্থ ব্যক্তি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
অবশ্যই পড়ুনঃ মসজিদুল আকসার ১১ বিস্ময়কর তাৎপর্য
তাই এক্ষেত্রে কলকারীর উচিত আস্তে কথা বলা। অপর প্রান্তের ব্যক্তি যদি তার কথা শুনতে না পায় অত্যন্ত ভিড়ের বা শব্দের কারণে তবে তাকে একটু পরে ফোন দেওয়ার কথা বলা উচিত। তাছাড়া পাবলিক প্লেসে উচ্চ আওয়াজে কথা বললে নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও রক্ষা হয় না।
বেশি রাতে ফোন দিবেন না
কিছু মানুষ আছে যারা স্থান-কাল-পাত্র কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই নিজেদের প্রয়োজনে হুটহাট যখন তখন যাকে তাকে ফোন দিয়ে বসেন। এটি এক ধরনের অভদ্রতা। সাধারণত রাত দশটার পরে এবং সকাল আটটার আগে ফোন দেওয়া উচিত নয়।
আপনার যদি অত্যন্ত জরুরি কোন প্রয়োজন থেকে থাকে তবে তবে ফোন দেওয়ার পরে রিসিভ করলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তির কাছে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিবেন এত রাতে ফোন দেওয়ার জন্য। আর যদি এমন অবস্থা হয় যে বিষয়টি জরুরী তবে কালকে খুব সকালে কথা বললেও চলবে- তবে এই পরিস্থিতিতে আপনি রাতে কল রিসিভ কারী ব্যক্তির কাছে একটি মেসেজ দিয়ে রাখতে পারেন।
মসজিদে যাওয়ার পূর্বে মোবাইল সাইলেন্ট করুন
মসজিদের যাওয়ার পূর্বে অবশ্যই আপনার মোবাইল সাইলেন্ট অথবা ভাইব্রেশন মোডে সেট করুন। মসজিদের ভেতর যেমন কথা বলা নিষিদ্ধ তেমনি ফোন আসলে ফোন রিসিভ করা বা কাউকে কল দেওয়া অনুচিত কাজ। আর এই জন্যই ফোন আসলে যেন বোঝা না যায় তার জন্য সাইলেন্ট অথবা ভাইব্রেশন করা যেতে পারে। ভাইব্রেশন বা সাইলেন্ট করা না হলে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলে এটি যেমন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু দেখায় তেমনি নামাজি ব্যক্তিদের নামাজের মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়।
পরে ফোন করার কথা বলুন
ধরুন আপনি কাঁচাবাজার করতে গিয়েছেন এই সময় আপনার পরিচিত কেউ অপ্রয়োজনে অর্থাৎ ততটা প্রয়োজন নয় এমন বিষয় নিয়ে আপনার সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছেন। আপনি যদি বিরক্ত বোধ করে থাকেন তবুও শান্ত ভাষায় তাকে বলুন আপনি ব্যস্ত আছেন পরে ফোন দিবেন। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে কিছু না বলেই কল কেটে দেয়াটা সমীচীন নয়।
আবার আপনি কোন অফিস থেকে সেবা নিতে চাচ্ছেন। সেই অফিসের একজনের সাথে আপনার পরিচয় রয়েছে অনেক দিন ধরেই। তো আপনি সেই অফিসে কখন যাবেন এবং সেবা নিবেন সেটা জানার জন্য একবার ফোন দেওয়ার পরে যদি উনি রিসিভ না করেন তবে তাকে মেসেজে জানিয়ে দিতে পারেন আপনি কখন উনার কাছে যেতে চাচ্ছেন।
চেষ্টা করুন শুদ্ধভাবে কথা বলতে
নিজ এলাকায় বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলার সময় আপনি আপনার নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই পারেন। তবে যে কোন অফিসিয়াল কথোপকথনে চেষ্টা করবেন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে। ধরুন একটি ব্যাংক থেকে একজন কর্মকর্তা যিনি রাজশাহী জেলার বাসিন্দা ফোন দিয়েছেন একজন কাস্টমারকে যিনি চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা।
এখন যিনি কাস্টমার তিনি যদি তার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন তবে সেই কর্মকর্তা প্রায় ৯০% কথাই বুঝতে পারবেন না। এক্ষেত্রে সে কাস্টমার যদি একদমই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে না পারেন অন্তত তার উচিত হবে ধীরে ধীরে কথা বলা।
শেষ কথা
ভদ্র, সুন্দর. মার্জিতভাবে এবং শুদ্ধ উচ্চারণে বুঝিয়ে কথা বলা একটি শিল্প বা আর্ট। এটি শুনতে যত ভালো লাগে বলতে যত কঠিন মনে হয় রপ্ত করাটা তার চাইতেও বড় কঠিন। এটি অনেকটা অধ্যাবসায়ের মতো। নিয়মিত চর্চা করতে হয়।
শুধু সামনাসামনি কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলতে গেলে যে এভাবে শুদ্ধভাবে গুছিয়ে কথা বলার প্রয়োজন তা নয় মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রেও আমাদের এই শৈল্পিক পারদর্শিতা প্রদর্শন করা উচিত। শুধু মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রে নয় সরাসরি কথা বলার ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি ভদ্রতা নম্রতা বজায় রাখবে সম্মান তারই বাড়বে।
যাইহোক উপরের লেখাগুলো পড়ে আশা করি আপনারা একটুও বিরক্ত হননি। পড়ে যদি একটু ভালো লেগে থাকে তবে পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এরকম তথ্যবহুল আরো বিভিন্ন লেখা রয়েছে এ ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url