আখেরি চাহার সোম্বা ২০২৪ | পরিচিতি এবং ইতিহাস

এই বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখে অর্থাৎ আরবি সফর মাসের ৩০ তারিখ বুধবার আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগণ ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যথাযথ ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে দিবসটি পালন করে আসছেন। তবে মুসলিম হওয়া সত্বেও আমরা অনেকেই জানিনা এই দিবসটি কেন পালন করা হয়।
আখেরি চাহার সোম্বা ২০২৪ পরিচিতি এবং ইতিহাস

ইসলামিক তথ্যের আজকের এই পর্বে আমরা জানবো আখেরি চাহার সোম্বা কি, কেন পালন করা হয় এবং এর ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

আখেরি চাহার সোম্বা কি?

“আখেরি চাহার সোম্বা” শব্দগুচ্ছ আরবি এবং ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। হিজরী সালের দ্বিতীয় মাস হল 'সফর' যেটি একটি ফার্সি শব্দ এবং ফার্সি ভাষায় এটিকে বলা হয় 'চাহার'। আবার আখেরি আরবি শব্দ যার অর্থ 'শেষ' এবং সোম্বা ফার্সি শব্দ যার অর্থ 'বুধবার'। সুতরাং আখেরি চাহার সোম্বার এর পূর্ণ অর্থ হলো “সফর মাসের শেষ বুধবার।” দিনটি আসলে একটি খুশির দিন হিসেবেই মুসলিম বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। তো আখেরি চাহার সোম্বার অর্থ আমরা জানলাম কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এই দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

কি কারনে আখেরি চাহার সোম্বা বিশেষ দিন

সময়টি ছিল তখন ১১ হিজরীর একদম শুরুর দিকে। সেই সময় অর্থাৎ সফর মাসের শুরুর দিকেই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি এতটাই অসুস্থ হয়েছিলেন যে বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না এবং ইমামতি পর্যন্ত করতে পারেন নি। তবে সফর মাসের ২৮ তারিখ বুধবার প্রিয় নবী (সা:) কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। 

এদিন তিনি সাত কুয়ার পানি দিয়ে গোসল করেন এবং মসজিদে নববীতে ইমামতি করেন। এদিন দুপুরে তিনি হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং দুই নাতি হাসান ও হোসেনকে নিয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। কাফের মুশরিকরা নবীজি (সা:) এর অসুস্থতায় খুশি হলেও মদিনার মুমিন বান্দারা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনযাপন করছিলেন। 
তবে ২৮ তারিখ বুধবার মহানবী (সা:) এর সুস্থতার খবরে মদিনাবাসী এতই খুশি হন যে তারা এক নজর দেখতে আসেন নবীজি (সা:) কে। নবীজির (সা:) সুস্থতায় খুশি হয়ে প্রত্যেক সাহাবী কিছু না কিছু ভাল কাজ করেছিলেন যেমন কেউ নফল নামাজ পড়েছিলেন, কেউ দান সদকা করেছিলেন, কেউ আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। 

যাদের সামর্থ্য ছিল তাদের মধ্যে কেউ দাসমুক্ত করেছিলেন, কেউ উট দান করেছিলেন। আবার জানা যায় ওমর (র:) ৭০০০ দিরহাম, আবু বকর সিদ্দীক (র:) ৫ হাজার দিরহাম, আলী (র:) ৩০০০ দিরহাম, ওসমান (র:) ১০০০০ দিরহাম দান করেন। এভাবে প্রতিবছর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার দিনটিকে স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী করে দিনটিকে পালন করে আসছে। আখেরি চাহার সোম্বা পালনের মূলত এটিই কারণ।

তবে এই দিন সন্ধ্যার সময় থেকে তিনি আবারও অসুস্থ হতে শুরু করেন। অর্থাৎ সুস্থ হওয়ার পরের দিন ২৯ সফর বৃহস্পতিবার মহানবী (সা:) আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার কিছুদিন পরে ১২ই রবিউল আউয়াল আমাদের প্রিয় নবী (সা:) ইন্তেকাল করেন।

এই দিনটি পালনের পেছনে প্রকৃত ইতিহাস

আখেরি চাহার সম্বা উদযাপনের প্রকৃত ইতিহাস আমরা সিরাত গ্রন্থ থেকে জানতে পারি। সীরাত অনুযায়ী বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এর মতে সফল মাসের শেষ পর্যায়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে অন্তিম যাত্রার সময় অসুখে পড়েন। ওই সময় একদিন মধ্য হতে তিনি বাকিউল গারকাদ বা জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে যান মৃত মানুষের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে। 

শেষ রাতে বাসায় ফিরে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে দিনে দিনে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং অসুস্থতার মাত্রা বাড়তে থাকে। সিরাত গ্রন্থে নবীজি (সা:) এর সাথে তার ক্রীতদাস হিবার কিছু কথোপকথনের উল্লেখ রয়েছে। কবরস্থানে যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিয়েছিলেন তখন তার ক্রীতদাস হিবাযও সেখানে ছিলেন। 
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিবাকে দেখে বলেছিলেন, আল্লাহর তরফ থেকে তাকে দুটি বিষয়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে। প্রথমটি হল ইহ জগতের ধন-সম্পদের ভান্ডার এবং দীর্ঘজীবন। আর দ্বিতীয়টি হলো আল্লাহর দিদার লাভ এবং বেহেশত লাভ। ক্রীতদাস হিবা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমটি বেছে নিতে পরামর্শ দেন। 

কিন্তু তিনি দ্বিতীয়টি পছন্দ করার বিষয়ে জানান। অর্থাৎ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহ জগতের সকল মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভের মাধ্যমে বেহেস্তে যেতে চান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ইচ্ছার প্রেক্ষিতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার এই অসুস্থতাই যে তার মৃত্যু পথযাত্রার সূচনা করেছে সেটা একমাত্র তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন। 

এভাবে দিনে দিনে অসুস্থ হতে শুরু করেন তার অসুস্থতা বাড়তে থাকে তিনি এই মুহূর্তে মুহূর্তেই জ্ঞান হারাতেন। আবিসিনিয়া থেকে তার জন্য ওষুধ আনা হয়েছিল কিন্তু সেই ওষুধে তেমন কোন কাজ হয়নি। এ অবস্থা দেখে নবীজি পরিবারের লোকজন এবং তার সাহাবীরা তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এভাবে চলতে চলতেই সফর মাসের শেষ বুধবার অর্থাৎ ২৮ তারিখে তিনি হঠাৎ কিছুটা সুস্থতা বোধ করেন। 

তার প্রিয়জনদের মাঝে আশার আলো সঞ্চার হতে থাকে। তার জ্ঞান ফিরে এলে তিনি অনেকটাই সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করলেন, স্বাভাবিক কাজকর্ম করলেন, নামাজ আদায় করলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সুস্থতায় তার প্রিয়জন সাহাবা সাহাবাগণ এবং তার পরিবেশদর্শন খুশিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। 

নামাজ পড়া থেকে শুরু করে দান সদকা সবকিছুই করলেন যে যা পেরেছেন। তার এই একদিনের সুস্থতা কে স্মরণ করার জন্যই এখন পর্যন্ত প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন এই দিবসটি বিশেষভাবে পালন করে আসছে।

প্রিয় নবী (সা:) এর অসুস্থতা

সফর মাসের শুরুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অসুস্থতায় পড়েছিলেন সেই বিষয়ে মূলত দুটি তথ্য পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাকের মতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকী কবরস্থান থেকে ফেরার পরে মারাত্মক শিরপীড়ায় আক্রান্ত হন। আবার ইবনে হাসেম এর মতে বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা:) তাঁর অন্তিমযাত্রায় তীব্র মাথা ব্যথার শিকার হন। 
আসলে দুটি তথ্যই সঠিক। মূলত তীব্র শিরপিড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে আমাদের প্রিয় নবী (সা:) তীব্র মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। মাথা ব্যথা এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি প্রায় সময়ে অজ্ঞান থাকতেন। কখনো জ্ঞান ফিরলে তৎক্ষণাৎ আবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন।

আখেরি চাহার সোম্বা নিয়ে বিতর্ক

একদল ইসলামিক স্কলার রয়েছেন যারা আখেরি চাহার সোম্বা পালনের বিপক্ষে অবস্থান করেন। তাদের যুক্তিটা হচ্ছে এরকম, আখেরি চাহার সোম্বা নিয়ে যে ইতিহাস বা গল্প রয়েছে সেটি মূলত সঠিক নয়। এ ধরনের কোন ঘটনা হাদিসের বিশাল ভান্ডারে খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতে কতিপয় কিছু বক্তা এই গল্পটি এমন ফলাও করে প্রচার করেন যে সাধারণ মানুষ এটিকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হন। 


অবশ্যই পড়ুন
আসলে এই ঘটনার ভিত্তি কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। অথবা এই ঘটনার সত্যতা মহানবী (সা:) এর হাদিস বা সাহাবাগণের হাদিস সূত্রে প্রমাণিত নয়। তাদের যুক্তি হল মহানবী (সাঃ) তথাকথিত এই ঘটনার সময় জীবনের প্রথম অসুস্থতায় পড়েননি। এর আগেও তিনি বহুবার অসুখে পড়েছেন, সুস্থ হয়েছেন, জাদু থেকে মুক্ত হয়েছেন, বিভিন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছেন। 

তো সেই দিবসগুলোকে কিন্তু কোন আলেমই প্রতি বছর স্মরণ করার জন্য পালন করেন না। তাহলে এই দিনটিকে কেন এত গুরুত্বের সাথে পালন করছেন? তাদের মতে আসলে যেহেতু ঘটনাটারই কোন ভিত্তি নেই তাই এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আমলেরও কোন ভিত্তি নেই। এক কথায় এসব কর্মকাণ্ডকে তারা বিদআত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

ইসলামে কোরআন এবং হাদিসে যা পালনের জন্য বলা হয়নি সেটি পালন করাই হলো বিদআত। আবার এই দিন আমাদের দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছুটি দেয়া হয়। তাদের মতে এটি একটি ভিত্তিহীন সিদ্ধান্ত।

নিজস্ব কিছু কথা

আখেরি চাহার সোম্বা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যত মতবাদ থাকুক না কেন আমরা এটির ভালো দিকটা গ্রহণ করতেই পারি। মহানবী (সা:) যেদিন সুস্থ হয়েছিলেন ২৮ তারিখে সেদিন তার পরিবারের সদস্য এবং সাহাবা একরামের আনন্দ খুশি দেখে আমরা এটুকু বুঝতে পারি তারা নবীজি (সা:) কে কতটা ভালোবাসতেন। আমরা নবীজি (সা:) এর উম্মত তাই আমাদের উচিত আমাদের পরিবার-পরিজন এবং আমাদের নিজের জীবনের চেয়ে উনাকে বেশি ভালোবাসা।
যেহেতু আখেরি যাহার সোম্বা সম্পর্কে হাদিসে কোন তথ্য পাওয়া যায় না তাই এটিকে যে পালন করতেই হবে এমন কোন বিষয় নেই। তাছাড়া এ উপলক্ষে যে আমলগুলো সাধারণত করা হয় সেগুলো এই দিবস এর নিয়তে পালন না করে আমরা এমনিও পালন করতে পারি। আরবি প্রত্যেক মাসেই নফল কিছু ইবাদতের নির্দেশনা দিয়েছেন মহানবী (সা:)। 

এছাড়াও সাপ্তাহিক ফজিলতপূর্ণ ইবাদত রয়েছে যেমন প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা, প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করা, প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজ নামের রোজা পালন করা ইত্যাদি। মহানবী সাঃ এর উম্মত হিসেবে আমাদের উচিত এসব ফজিলতপূর্ণ ইবাদত পালন করে সওয়াব অর্জন করা।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url