চাকরির ইন্টারভিউতে জীবন বৃত্তান্ত সুবিন্যস্ত ভাবে উপস্থাপন করার কৌশল

একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন যোগ্য প্রার্থী নিয়োগের জন্য যাচাই-বাছাই করার অন্যতম উত্তম প্রক্রিয়া হলো ইন্টারভিউ। আর ইন্টারভিউ এর মূল অংশ হচ্ছে চাকরি প্রার্থীর জীবন বৃত্তান্ত। ইন্টারভিউ আপনার বায়োডাটা বা জীবন বৃত্তান্ত কে এমন ভাবে উপস্থাপন করার একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে যা আপনাকে একজন আবেদনকারী হিসেবে অন্যদের চাইতে আলাদা করে তুলবে এবং আপনার অভিজ্ঞতার সবচেয়ে পজেটিভ দিকগুলোর উপর জোর দেওয়ার সুযোগ দেবে।
চাকরির ইন্টারভিউতে জীবন বৃত্তান্ত সুবিন্যস্ত ভাবে উপস্থাপন করার কৌশল

সান ফ্রান্সিসকোর ক্যারিয়ার এন্ড লাইফ কোচ কলিন ক্যাম্পবেল তার একটি নিবন্ধে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন ইন্টারভিউ বোর্ডে কিভাবে বায়োডাটা উপস্থাপন করতে হয়। “ক্যারিয়ার” এর আজকের এই পর্বে আমরা জানবো চাকরির ইন্টারভিউ তে জীবন বৃত্তান্ত সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করার কৌশল সম্পর্কে। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

জীবন বৃত্তান্তের ফরমেট ঠিক করুন

চাকরির ইন্টারভিউ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হল বায়োডাটা বা জীবন বৃত্তান্ত। একজন চাকরির প্রার্থীর বাহ্যিক গেটাপের পরেই জীবন বৃত্তান্তের অবস্থান। প্রথম দেখাতেই যদি জীবন বৃত্তান্ত দেখে আকৃষ্ট হন প্রশ্নকর্তারা তবে এটা একটি বোনাস হিসেবে পাওয়া একজন চাকরি প্রার্থীর জন্য। তাই ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের নজরে আনার জন্য অবশ্যই আপনাকে আপনার জীবন বৃত্তান্তের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। 

জীবন বৃত্তান্তের সঠিক ফরমেট হয়েছে কিনা সেটাকে যাচাই করুন। প্রত্যেক পেজের ফন্ট সাইজ হতে হবে ১০ অথবা ১২ এর বেশি নয় এর কমও নয়। ফন্টের স্ট্যান্ডার্ড স্টাইল হচ্ছে “টাইমস নিউ রোম্যান”। প্রতিটি পৃষ্ঠার চারিদিকে এক ইঞ্চি করে অর্থাৎ ২.৫ সেন্টিমিটার মার্জিন দিতে হবে। জীবন বৃত্তান্তের প্রথম পৃষ্ঠায় উপরের দিকে অবশ্যই আপনার নাম বড় অক্ষরে লিখতে হবে এবং তার নিচে ইমেইল, ফোন নাম্বার, হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার সহ যাবতীয় যোগাযোগের ঠিকানা লিখতে হবে। 
চাকরি দাতারা যেন সহজে আপনার নাম এবং আপনার যোগাযোগের ঠিকানা খুঁজে পায়। আপনার নাম এবং যোগাযোগের ঠিকানা অবশ্যই পৃষ্ঠার কেন্দ্রে লিখার চেষ্টা করবেন তবে অন্যান্য তথ্যগুলো অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী অর্থাৎ বাম পাশ থেকে লিখবেন। এরপরে প্রথমে লিখবেন স্কিল এবং দক্ষতার যাবতীয় বিষয়, তারপরে লিখবেন শিক্ষাগত যোগ্যতা, এরপর লিখবেন আপনার পূর্ববর্তী চাকুরীর অভিজ্ঞতা (যদি থাকে)। 

এই বিষয়গুলো যতটা সম্ভব বিস্তারিত খুঁটিনাটি লিখার চেষ্টা করবেন। এবং বিশেষভাবে খেয়াল রাখবেন অপ্রয়োজনীয় অংশ যেন আপনার সিভিতে না থাকে। যেমন আপনার হবি, আপনি কি খেতে পছন্দ করেন ইত্যাদি বিষয় গুলোর মত অপ্রয়োজনীয় তথ্য বায়োডাটাতে উল্লেখ করবেন না। চাকরি দেওয়ার স্বার্থে আপনার এসব তুচ্ছ তথ্য জানার কোন প্রয়োজন নাই চাকরি দাতাদের। 

যদি থাকে তাহলে দুইজন অথবা তিনজনের রেফারেন্স দিতে পারেন। তবে বিশেষভাবে সতর্ক থাকবেন রেফারেন্স সহ কোন তথ্যই যেন ভুল বা মিথ্যা না থাকে। প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করার পরে অনেক সময় কর্তৃপক্ষ রেফারেন্সে দেওয়া ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। আপনি ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে সেখানেই আপনার চাকরির পরিসমাপ্তি ঘটবে।

অন্যান্য কাগজপত্র গুছিয়ে রাখুন

একটি চাকরির ইন্টারভিউতে জীবন বৃত্তান্তের সাথে আরও অনেক কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদপত্রের কপি, জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি, আবেদন পত্র, কাভার লেটার সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র চাহিদা মোতাবেক। 

অনেকে আছেন এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো একসাথে করে নিয়ে একটি ব্যাগে বা ফাইলে করে নিয়ে চলে যায় এবং ইন্টারভিউ বোর্ডে নির্দিষ্ট করে যখন কোন কাগজ চাওয়া হয় তখন তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন কোথায় আছে কাগজটি। তাই সবার প্রথমে জীবন বৃত্তান্ত, তারপরে আবেদন পত্র, তারপরে কভার লেটার, তারপরে শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্র, এরপরে অভিজ্ঞতার সনদপত্র ইত্যাদি এইভাবে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে রাখুন এবং সেটা ভালো করে মনে রাখুন। 
সবচেয়ে ভালো হয় একটি বড় ব্যাগ বা পোর্টফোলিও নিবেন এবং এর মধ্যে আপনার প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় কাগজের অংশের জন্য আলাদা আলাদা ফাইল ব্যবহার করবেন যে ফাইলগুলোর উপরে কিসের কাগজপত্র সেটা লেখা থাকবে।

কাগজ পত্রের ক্ষেত্রে পরিপাটি হন

চাকরিটা পেলে আপনি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছেন। তাই ইন্টারভিউ এর প্রতিটা অংশে আপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেকে মনে করেন ইন্টারভিউ বোর্ডে সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারলেই চাকরি সুনিশ্চিত। তবে এ ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আপনি ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রবেশ করার পর থেকে আপনার বাহ্যিক পোশাক পরিচ্ছদ, আচরণ, কথা বলা, জীবন বৃত্তান্তের উপস্থাপন, কাগজপত্রের নমুনা সবকিছুই চাকরি দাতারা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। 

সেজন্য আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। আপনি যে তথ্যগুলো প্রিন্ট করবেন অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা যদি ফটোকপি করেন তা অবশ্যই আপনাকে উন্নত মানের কাগজ অর্থাৎ অফসেট পেপার ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ কোনো কাগজে এসব প্রিন্ট বা ফটোকপি করা যাবে না। 
আবার আপনি ফাইল বা ব্যাগ থেকে আপনার কাগজপত্র বের করে চাকরিদাতাদের দিলেন কিন্তু কাগজগুলো ভাজ অবস্থায় আছে অথবা দুমড়ে-মুচড়ে আছে। কাগজপত্রের এই হাল দেখলে আপনার প্রতি চাকরিদাতাদের অবশ্যই কোন ইতিবাচক ধারণা জন্মাবে না।

পর্যাপ্ত কপি আনুন

বায়োডাটা, কভার লেটার, অভিজ্ঞতার কাগজপত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদের কাগজপত্র - প্রতিটা অংশের কমপক্ষে তিন সেট করে কপি নিয়ে ভাইবা বোর্ডে উপস্থিত হবেন। কারন আপনি জানেন না ভাইভা বোর্ডে কতজন প্রশ্নকর্তা থাকবেন। 

একজন থাকলে এক কপি করে কাগজপত্র যথেষ্ট কিন্তু যদি দুই বা তিনজনের অধিক থেকে থাকেন তবে এক কপি করে কাগজ সবাই কে দেখানো একটি বিড়ম্বনা এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ভাইভা বোর্ডের প্রত্যেক জন সদস্যের আপনার তথ্য সম্পূর্ণভাবে দেখার জন্য পর্যাপ্ত কপি না থাকাটা আপনার জন্যও ভালো কিছু হতে পারে না।

কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করে রাখুন

ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের সামনে আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং জীবন বৃত্তান্ত উপস্থাপন করার পরে আপনার নিজেকে উপস্থাপন করার পালা আসবে। প্রশ্নকর্তারা কিছু প্রশ্ন করবেন যেগুলো জীবন বৃত্তান্তে উল্লেখিত তথ্য সম্পর্কিত আপনার পূর্ববর্তী চাকরিতে অর্জিত কোনো দক্ষতা বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে। 

উদাহরণস্বরূপ, “আগের চাকরিতে অর্জিত এ দক্ষতাটি আপনি এই প্রতিষ্ঠানে কিভাবে কাজে লাগাতে পারবেন?” আবার কিছু প্রশ্ন করবেন যেগুলো আপনার জীবন বৃত্তান্তে উল্লেখ নেই। উদাহরণস্বরূপ, “এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য আপনি নিজেকে কেন উপযুক্ত মনে করছেন?” এগুলো সাধারণত খুবই সাধারণ প্রশ্ন যেটা প্রায় প্রত্যেকটি ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করা হয়। 
তাই এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখবেন যেন সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে উত্তরগুলো দিতে পারেন। আপনার দক্ষতা বিষয়ে যদি কেউ প্রশ্ন না করে থাকে তবে আপনি সুযোগ খুঁজবেন আপনার দক্ষতা বিষয়ে বিস্তারিত না হোক অন্তত সংক্ষেপে কিছু বলার। অথবা প্রশ্ন করতে পারেন এভাবে- “আমার দক্ষতার কোন বিষয় সম্পর্কে কিছু কি জানতে চান?” 

মনে রাখবেন প্রশ্নকর্তাদের সামনে আপনি নিজেকে নিজের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান সম্পর্কে যত মেলে ধরবেন ততই আপনার প্রতি তারা আকৃষ্ট হবে। তবে এই সুযোগটি নিজেকে করে নিতে হবে সবসময় পরিস্থিতি আপনার অনুকূলে নাও থাকতে পারে। চাকরির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় তবে সবগুলো অভিজ্ঞতা সম্পর্কে না বলে বরং যে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন সেই চাকরির সাথে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার বিষয়ে আলোচনা করুন। 

আগের চাকরিগুলো ছেড়ে এই চাকরির জন্য কেন আবেদন করেছেন এমন প্রশ্ন করলে যুক্তিসম্মত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন। কখনোই আগের প্রতিষ্ঠানের কোন দুর্নাম বা বদনাম করবেন না। এতে করে আপনার প্রতি প্রশ্নকর্তাদের একটি নেতিবাচক ধারণার উদয় হবে। তারা ধরে নেবে প্রতিষ্ঠান নয় আপনার মধ্যেই কোন সমস্যা থাকতে পারে।

মন্তব্য

চাকরি প্রত্যাশীদের চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সঠিকভাবে জীবন বৃত্তান্ত তৈরি করা এবং ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থাপন করা। একাডেমিক এবং দক্ষতার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও জীবন বৃত্তান্ত তৈরীর ক্ষেত্রে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেক চাকরি প্রত্যাশীদের জন্যই উপরের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে, আশা করা যায় কিছুটা হলেও তাদের উপকার হবে।

আমাদের ওয়েবসাইটে এসে লেখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ ধরনের আরও তথ্যবহুল এবং উপকারী লেখা পড়তে চাইলে নিয়মিত ভিজিট করুন আমাদের এই ওয়েবসাইট। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে নিজের শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ভালো থাকবেন ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url