মোবাইল ফোনে অফিসিয়ালি কথা বলার শিষ্টাচার | জেনে নিন ১৩টি আদব
আমরা যেকোন প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত, অপরিচিত যে কারো সাথে যখন তখন কথা বলে থাকি। এসব ক্ষেত্রে ততটা নিয়মকানুন না মেনে চললেও প্রফেশনালি অর্থাৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা যেকোনো অফিসের কাজে যখন কোন ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলা দরকার পড়ে তখন আমাদের বিশেষ কিছু শিষ্টাচার বা নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভয়েস এবং স্পিচ কোচ প্যাট্রিক মিউনজ মোবাইলে প্রফেশনালি কথা বলার নিয়ম-কানুন বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন তার লেখা একটি নিবন্ধে। “স্মার্টফোন” এর আজকের এই পর্বে আমরা সেই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করব। তো চলুন জেনে নেই প্রফেশনালি স্মার্টফোনে কথা বলার কিছু নিয়মকানুন। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
প্রয়োজনীয় উপকরণ সামনে রাখুন
আপনি যদি কোন অফিসের রিসিপশনিস্ট বা কল সেন্টার কাজ করেন অথবা এমন কাজ যেখানে কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে প্রতিনিয়ত কথা বলতে হয় সে ক্ষেত্রে আপনার সামনে একটি কলম, একটি লেখার প্যাড, একটি ক্যালেন্ডার রাখতে পারেন। হয়তো মনে করতে পারেন প্রতিটা স্মার্টফোনেরই নোটপ্যাড নামে যে অ্যাপ থাকে সেটিতে তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে।
কিন্তু সেটি করতে হলে আপনাকে কথা বলার শেষে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে কিন্তু সামনে যদি কাগজ-কলম থাকে তবে আপনি কথা বলার মুহূর্তেই তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন। তথ্যের মধ্যে রয়েছে কে ফোন দিয়েছিল তার নাম, কোথায় থেকে ফোন দিয়েছিল, কয়টার সময় ফোন দিয়েছিল, কবে ফোন দিয়েছিল ইত্যাদি।
দ্রুত কল রিসিভ করুন
আপনি কোন কোম্পানির মালিক অথবা কর্মচারী হোন না কেন, কোন কাস্টমার কল করলে যথাসম্ভব দ্রুত রিসিভ করার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার কোম্পানির সম্পর্কে তাদের যেমন একটা পজিটিভ ধারণা হবে ঠিক তেমনি কাস্টমারের কলের প্রতি আপনাদের গুরুত্ব রয়েছে এ বিষয়টিও তারা বুঝতে পারবে।
প্রতিষ্ঠান এবং নিজের পরিচয় দিন
কল রিসিভ করার সাথে সাথেই নিজের প্রতিষ্ঠান এবং নিজের নাম সহ পরিচয় তুলে ধরুন। একই সাথে অপরপ্রান্তের লোক যদি তার পরিচয় না দিয়ে থাকে তবে তাকেও জিজ্ঞেস করুন উনি কে এবং কোথায় থেকে কল করছেন। উদাহরণস্বরূপ, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মুবীন পিডিয়াতে ফোন করার জন্য। আমি জাকির কথা বলছি। আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? দয়া করে আপনার পরিচয়টা দিবেন?”
ধৈর্যের সাথে প্রশ্ন করুন
একটি কোম্পানিতে ক্লায়েন্টদের পাশাপাশি বিভিন্ন অযাচিত কল আসতে পারে এটাই স্বাভাবিক। তবে কোম্পানির ক্লায়েন্ট বা কাস্টমার না হলে সেখানে বিরক্তবোধ না করে ধৈর্যের সাথে প্রশ্ন করার চেষ্টা করুন। উদাহরণস্বরূপ,
কলার: আমি কি শিহাবের সাথে কথা বলতে পারি?
রিসিভ কারী: আমি কি জানতে পারি কে কল করেছে?
কলার: আজগর
রিসিভ কারী: আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন
কলার: চট্টগ্রাম
রিসিভ কারী: আপনার কোম্পানির নাম বলবেন দয়া করে?
কলার: এটি একটি ব্যক্তিগত ফোন।
রিসিভ কারী: শিহাবকে কি আপনার ফোন করার কথা ছিল?
কলার: না
রিসিভ কারী: আচ্ছা আমি দেখছি তাকে লাইনে পাওয়া যায় কিনা।
যথাসময়ে সংযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করুন
কোন কাস্টমার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অথবা অন্য কোন কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে চাইলে সে কাস্টমারকে হোল্ড করার আগে দুই মিনিট সময় চেয়ে নিন। যদি বুঝতে পারেন দুই মিনিটের মধ্যে কাঙ্খিত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয় তবে বিনয়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ করুন এবং জানিয়ে দিন কিছুক্ষণ পরে তার সাথে আপনি যোগাযোগ করবেন।
নিজের কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দিন
কোন ব্যক্তি আপনার কর্মস্থলে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে ফোন দিলে আপনাকে কিন্তু দেখতে পাবে না। তবে আপনার কণ্ঠস্বর শুনেই তারা আপনার আচরণ বুঝতে পারবে। আপনি কতটা আগ্রহ, গুরুত্ব এবং উৎসাহের সাথে অপর প্রান্তের ব্যক্তির সাথে কথা বলছেন সেটা আপনার কণ্ঠস্বরের টোন শুনেই কল কারী ব্যক্তি বুঝতে পারবেন।
তাই সব সময় বিনয়ী, ভদ্র এবং শান্ত কণ্ঠস্বরে কথা বলুন যদিও সে কাস্টমার বিরক্ত সৃষ্টিকারী কোন প্রশ্ন বা আচরণ করে থাকে। এতে করে আপনার প্রতি আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটা ভালো ইমেজ তৈরি হবে।
নাম ব্যবহার করুন
কথোপকথনের সময় যতটা সম্ভব যিনি কল করেছেন তার নাম ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এতে করে অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি নিশ্চিত হবেন যে আপনি সচেতনতার সাথে তার কথা শুনছেন এবং তার সাথে কথা বলছেন।
উদাহরণস্বর, “আমি দুঃখিত জাহিদ সাহেব, এই মুহূর্তে শিহাব স্যার একটি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। উনার জন্য কোন মেসেজ আছে কি?” বাইরের দেশে শুধুমাত্র নাম বলার প্রচলন থাকলেও আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে শুধু নাম না বলে তার সাথে একটি সম্পর্কের সম্বোধন করতে হয়। নামের সাথে স্যার, জনাব, সাহেব, মহোদয় ইত্যাদি যোগ করতে হয়।
নিজের পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করুন
কোন ক্লায়েন্ট আপনার প্রতিষ্ঠানে ফোন দেওয়ার সময় যেমন নিজের পরিচয় দিবেন ঠিক তেমনি আপনি যখন কোন ক্লায়েন্টকে ফোন দিবেন শুরুতেই নিজের নাম এবং পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করুন। উদাহরণস্বরূপ, “আমি মুবীন পিডিয়া থেকে জাকির বলছি।
আপনি কি মিথিলা বলছেন?” তবে খেয়াল রাখবেন অনর্থক কথা বাড়িয়ে ক্লায়েন্টকে যেন বিরক্ত করা না হয়। নিজের নাম পরিচয় দেয়ার পরপরই আপনি যে উদ্দেশ্যে ফোন করেছেন সরাসরি সে পয়েন্টে চলে যাবেন।
প্রফেশনালি কথা শেষ করুন
কথা শুরু করবেন যেমন প্রফেশনালি শেষও করবেন একইভাবে। শুধুমাত্র ‘আচ্ছা’, ‘ঠিক আছে’ বলে কথা শেষ করা এক ধরনের অভদ্রতা। উদাহরণস্বরূপ, “ফোন দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যেকোনো প্রয়োজনে পরবর্তীতে আবার ফোন করতে পারেন। আপনার দিনটি ভালো কাটুক।” এভাবে প্রফেশনালি কথা শেষ করলে আপনার এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্লায়েন্টদের একটা ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হবে। তাছাড়া উন্নত যে কোন বিশ্বেই এটি একটি অপরিহার্য শিষ্টাচার।
তর্ক করবেন না
কাস্টমারের সাথে কখনোই তর্ক করবেন না অথবা কাস্টমার যখন কথা বলে তার মাঝে কখনোই আপনি কথা বলে তাকে থামিয়ে দিবেন না। আপনি যদি শতভাগ নিশ্চিত হন যে কাস্টমার কোন কথা ভুল বলছে তবুও তার কথাটি সম্পূর্ণ শোনার পরে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেন।
তারপরেও ক্লায়েন্ট যদি তার ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে মানসিকভাবে অনড় থাকেন তবে তার সাথে তর্ক না করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন যে আপনি তার সমস্যা গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন এবং সম্ভব হলে সমাধান করার চেষ্টা করবেন।
সংযত থাকুন
কখনো কোন ক্লায়েন্ট যদি উচ্চস্বরে এবং চরম উত্তেজিত অবস্থায় আপনার সাথে কথা বলে আপনি ক্লায়েন্ট এর মত করে তার সাথে কখনোই কথা বলবেন না। ক্লায়েন্ট যত উত্তেজিত এবং উচ্চ গলায় কথা বলবেন আপনি ততটাই শান্ত এবং নিম্নস্বরে কথা বলুন।
একসময় দেখবেন ক্লায়েন্টও শান্ত বলায় কথা বলছেন। মনে রাখবেন যখন দুই পক্ষই চরম উত্তেজিত অবস্থায় কথা বলে তখনই পরিস্থিতিটা সকলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আপনার সংযত আচরণের কারণে দুই পক্ষের মধ্যে যদি একটি ফলপ্রসু কথোপকথন হয় আপনি নিজেও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন।
মাথা ঠান্ডা রাখুন
এমন কিছু ক্লায়েন্ট থাকে যারা শুধু উত্তেজিত হয়ে কথা বলে না অস্রাব্য এবং অশালীন ভাষাও ব্যবহার করে। এমন অবস্থায় কোনোভাবেই আপনাকে উত্তেজিত বা রাগান্বিত হলে চলবে না। আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে আপনি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এবং ক্লায়েন্টদের সমস্যা শুনে সমাধান করার চেষ্টা করাই আপনার কাজ।
বড় করে কয়েকটি নিঃশ্বাস নিন এবং ভাবুন ক্লায়েন্ট যা যা বলেছে উত্তেজিত অবস্থায় আপনি সেসব কিছুই শুনেননি। নিজেকে শান্ত করে বরং ক্লায়েন্টকে এটি বলুন যে আপনি তার উত্তেজনার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন এবং যদি উত্তেজিত না হয়ে উনার সমস্যাগুলো বলে তাহলে আপনি তার সমস্যার একটা সমাধান দিতে পারেন।
ব্যক্তিগত মন্তব্য করবেন না
অনেক ক্লাইন্ট আছে যারা সমস্যার কথা বলতে গিয়ে অনেক ব্যক্তিগত কথাও বলতে পারে। কিন্তু আপনাকে এটি মাথায় রাখতে হবে যে, আপনি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মাত্র। তাই কাজটি যেহেতু প্রফেশনালি করছেন ক্লায়েন্টের উত্তর দিতে হবে আপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক উপায়েই।
ক্লায়েন্ট যদি তার সমস্যার প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে অন্য কোন ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে থাকেন তবে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে তার সমস্যার প্রসঙ্গে। আবেগ দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করুন এবং ব্যক্তিগত কোন ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।
মন্তব্য
প্রফেশনালি কথা বলার জন্য উপরে যে পয়েন্ট গুলো আলোচনা করা হয়েছে সেটা যে শুধুমাত্র অফিস বা কোন ব্যবসার ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য সেরকম নয়। এই শিষ্টাচারগুলো আমরা সব সময় প্রয়োগ করতে পারি। ভদ্র, মার্জিত এবং সুন্দরভাবে কথা বলাও একটি শিল্প। আর এই শিল্পে পারদর্শী হয়ে আমাদের সকলেরই শিল্পী হয়ে ওঠা উচিত। তাই বিষয়গুলো আমরা নিয়মিত চর্চা করি সেটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
আজ এ পর্যন্তই। আমাদের ওয়েবসাইটে এরকম তথ্যবহুল আরো অনেক নিবন্ধ রয়েছে সেগুলো ভিজিট করার অনুরোধ রইলো। উপরের প্যান্টগুলোর বাইরেও যদি আরো কিছু পয়েন্ট থেকে থাকে অথবা আজকের লেখায় কোন ভুল ত্রুটি হলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url