বিয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা | সন্তানদের সঠিক সময়ে বিয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ন কেন?
প্রতিটি নারী-পুরুষই বিয়ের দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। কারণ প্রতিটা মানুষের জীবনেই বিয়ের দিনটি একটি স্মরণীয় দিন। বিয়ের দিনেই তাদের নতুন জীবনের সূচনা হয়। তবে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো অনেকেরই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় যখন তারা বেশি বয়সে অর্থাৎ লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন।
বয়স বেশি হওয়ার কারণে তখন সহজেই পাত্র/পাত্রী খুঁজে পাওয়া যায় না মনের মত। এই অবস্থায় ছেলেমেয়েদের বিয়ের কথা চিন্তা করতে করতে বাবা মায়েরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ছেলে মেয়ে অর্থাৎ পাত্র-পাত্রী সহ তাদের বাবা মায়েরাও বুঝতে পারেন সঠিক সময়ে বিয়ে দেওয়ার গুরুত্ব কতখানি।
“পরিবার” এর আজকের এই পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করব সঠিক সময় সন্তানদের বিয়ে দেওয়া জরুরী কেন? তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে জেনে নেয়া যাক বিষয়গুলো।
চরিত্র রক্ষা হবে
বর্তমানে অশ্লীল আর বেহায়াপনার যুগে প্রতিটি তরুণ তরুণীর চরিত্র রক্ষা করাই একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জটি শুধুমাত্র সেইসব তরুণ তরুণীদের জন্য যারা ব্যাপারটির ভয়াবহতা জানে এবং বোঝে। আর যারা জানেনা তারা স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করছে। বর্তমান সমাজে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও নেমে পড়েছে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে।
শুধু প্রেম করেই এরা ক্ষান্ত হয় না, নিভৃতে নির্জনে চলে যায় আরো জঘন্যতম কাজ করতে। হাদিস থেকে পাওয়া যায় দুইজন পুরুষ এবং নারীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হলো শয়তান। আর শয়তান যেখানে থাকবে সেখানে কখনো ভালো কাজ হতে পারে না। এখনকার ছেলেমেয়েরা একটি দুটি নয় একসাথে চার থেকে পাঁচটি প্রেম করায় দক্ষ।
যেখানে একটি প্রেম করাই অনৈতিক এবং ইসলামিক শরীয়াহ মোতাবেক হারাম সেখানে এরা চার থেকে পাঁচটি প্রেম অবলীলায় করে যাচ্ছে। চরিত্রের কতটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটলে এরকম ঘটনা দেখা যায়। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টিই করেছেন এইভাবে যে, উপযুক্ত সময় হলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে অর্থাৎ জৈবিক চাহিদা পূরণের চাহিদা দেখা দিবে।
আর এর জন্যই উপযুক্ত কাজ হল সঠিক সময়ে সন্তানদের বিয়ে দেয়া। সঠিক সময়ে সন্তানদের বিয়ে দিলে একদিকে যেমন সন্তানদের চরিত্র রক্ষা হবে অন্যদিকে বাবা মায়েদের দায়িত্ব কর্তব্য পূরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে।
ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক জীবন যাপন করতে পারবে
ইসলামী শরীয়া মোতাবেক ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত বয়স হওয়ার মাত্র তাদের বিয়ে দেওয়া বাবা মায়ের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। বিয়ে ব্যাপারে বাংলাদেশের যে আইন রয়েছে অর্থাৎ মেয়েদের জন্য ১৮ বছর এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর সেটি মেনে চললেও ইসলামিক শরীয়া মোতাবেক জীবন যাপন করা সম্ভব। যদিও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছে।
ইসলামে বলা আছে উপযুক্ত বয়স হওয়া মাত্রই বিয়ে দিতে হবে আর বিয়ে দিতে বলার প্রধান কারণ হলো ছেলেমেয়েদের চরিত্র যেন রক্ষা হয়। কারণ উপযুক্ত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য ছেলে মেয়েরা নানারকম ফিতনা ফ্যাসাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়।
এতে করে একদিকে যেমন তরুণ সমাজ ইসলাম থেকে বিপথগামী হয়ে যায় অন্যদিকে নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক প্রেম সম্পূর্ণ হারাম একটি কাজ। আর সন্তানদের সঠিক সময়ে বিয়ে দিলে এই হারাম কাজ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে
সঠিক সময় বিয়ে দিলে ছেলেমেয়েদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ধরুন উপযুক্ত সময় আপনার সন্তানদের বিয়ে দিলেন এক্ষেত্রে তাদের মাথায় একটি চিন্তা থাকবে যে কিভাবে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারে এবং নিজের খরচ নিজে চালাতে পারে এই জন্য তারা অন্য আজেবাজে কাজ না করে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি বৈধ উপায়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করে যাবে।
সফল হলে তারা নিজেরা যেমন সঠিক পথে থাকবে ঠিক তেমনি সমাজের এবং পরিবারের মান সম্মান রক্ষা করবে। কিন্তু উপযুক্ত সময় বিয়ে না হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা পরকীয়া নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, বিভিন্ন নেশায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
সঠিক সময়ে সন্তান হয়
বর্তমানে আধুনিক যুগে নিসন্তান অথবা বন্ধ্যা দম্পতির সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সঠিক সময়ে বিয়ে না হওয়া। একটি ছেলের প্রতিষ্ঠিত হতে হতে ৩৫ বছর পার হয়ে যায়। তারপরেও ধীর স্থির হয়ে টাকা পয়সা জমিয়ে বিয়ে করতে করতে প্রায় ৩৮ বছর। একইভাবে আজকালকার মেয়েরাও নিজেরা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করতে চাই না এক্ষেত্রে তাদের বাবা-মায়েরও পূর্ণ সম্মতি থাকে।
ফলে ৩৮ বছরের একটি ছেলের সাথে ৩৫ বছরের একটি মেয়ের বিয়ে হলে স্বভাবতই তাদের সন্তান হতে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। অথচ উপযুক্ত বয়সে এদের বিয়ে হলে এদের সন্তান হয়তো উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে পারতো। সব বয়সেরই একটি মানানসই এর ব্যাপার থাকে। ২৫ বছরে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা যতটা উর্বর থাকে ৩৫ বছর বয়সে সে ক্ষমতাটি ততটাই অনুর্বর হয়ে যায়।
সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করা যায়
দেরিতে বিয়ে করার আরেক সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করা যায় না। একটি প্রতিষ্ঠিত ছেলের ৩৮ বছর বয়সে যদি বিয়ে হয় তাহলে তার সন্তান কলেজ পর্যায়ে যেতে না যেতেই তার চাকরি শেষ হয়ে যায়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পরবর্তীতে পেনশনের সুবিধা থাকলেও বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে এ ধরনের সুবিধা নেই। ফলে সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সন্তানের পড়াশোনা খরচ যোগাতে বাবা মায়েদের হিমশিম খেতে হয়।
দায়িত্ব ও কর্তব্য নিতে শিখে
একটু খেয়াল করে দেখলে আপনার লক্ষ্য করবেন অল্প বয়সে যাদের বিয়ে হয় তারা সহজে দায়িত্ব ও কর্তব্য নিতে শেখে। ১০ জন দম্পতির মাঝে এই জরিপ করলে প্রায় ৮ থেকে ৯ জনের ভেতরে দেখবেন দায়িত্ব ও কর্তব্য পরায়ণতা। তারা শুধু নিজের স্বামী/স্ত্রীর এবং সন্তানের দায়িত্ব নয় পরিবারের অর্থাৎ তাদের বাবা-মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিতে পিছুপা হয় না।
সঠিক সময়ে সন্তানের বিয়ে না হলে তারা মানসিকভাবে থাকে মুক্ত, তারা চিন্তা করে আমরা এখনো ছাত্র আমাদের কোন দায়িত্ব কর্তব্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে তারা দিনরাত বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ফুর্তি করে, আড্ডা মারে কিন্তু পরিবারের কোন দায়িত্ব নিতে চায় না।
সংসার সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করে
পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু থেকে অভিজ্ঞতার একটি বিশেষ কদর রয়েছে। বিয়ে এবং পরিবারের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অনেক। বেশি বয়সে যারা বিয়ে করেছেন তাদের চেয়ে অল্প বয়সে বিয়ে কারীদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর যাদের অভিজ্ঞতা যত বেশি তারা জীবনে হোঁচট খাবে ততই কম। সংসার যেমন একটি বেঁচে থাকার, আঁকড়ে থাকার জায়গা, আনন্দের এবং শান্তির জায়গা ঠিক তেমনি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারলে এই সংসারই কিন্তু মানুষের জীবনে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
যৌতুকের দর কষাকষি থাকে না
সামাজিকভাবে যৌতুক দেয়া এবং মেয়াদ উভয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি অত্যন্ত ঘৃণিত একটি কাজ। আমার মতে যৌতুক নেয়ার অর্থ হল বরকে পশুর মত বিক্রি করে দেয়া। এবং যে বাবা-মা যৌতুক নেয় তাদের ও নৈতিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এখন কথা হল একটি ছেলে ৩৮ বছর বয়সে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বিয়ে করতে গেলে তার দাম বাড়ানোর জন্যই যৌতুক নেয়া হয়।
অবশ্যই পড়ুন
কিন্তু ছাত্র অবস্থায় যদি একটা ছেলের বিয়ে হয় তখন সাধারণত যৌতুক নেয়া হয় না। কারণ ছেলেটি তখনো ছাত্র থাকে কর্ম করে না বিধায় তার জন্য কোন যৌতুক নেয়া হয় না। বর্তমানে অবশ্য ছেলেদের যৌতুকের দর কষাকষি অনেকটা কমে আসলেও মেয়েদের কাবিনের দর কষাকষি ব্যাপকভাবে প্রসার পেয়েছে। শিক্ষিত সমাজে চাকরিজীবী মেয়েদের কাবিন ১০ লাখের নিচে যেন হতেই চায় না।
এত উচ্চ মূল্যের কাবিন আদায় করতেও পাত্র-পক্ষের উপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাই এ কাজটিও অনেকটাই মেয়েকে বিক্রি করে দেওয়ার মতোই অথবা বিনা ইনভেস্টে ব্যবসায় লাভের মত যেটি যৌতুকের মতই অত্যন্ত ঘৃণিত এবং নিন্দনীয় কাজ।
তুলনামূলকভাবে অন্যান্যদের চাইতে আগে প্রতিষ্ঠিত হয়
আমাদের সমাজে বাবা মায়েদের ভেতর একটি চরম ভুল ধারণা দেখা যায় সেটি হল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না করলে আমার সন্তানের বিয়ে দেবো কিভাবে? তারা কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে, কি খাবে এসব ফালতু বিষয় নিয়ে বাবা-মায়েদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সন্তানকে সঠিক পারিবারিক শিক্ষা দিয়ে বড় করলে এবং সঠিক সময়ে বিয়ে দিলে সেই সন্তানের মাথায় আলাদা রকম একটি চাপ থাকে যে কখন সে প্রতিষ্ঠিত হবে।
কারণ বিয়ে করার পরে বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিজের এবং তার স্ত্রীর ভরণপোষণের খরচ নিতে কোন সন্তানেরই ভালো লাগার কথা নয়। একই বয়সে একই ক্ষেত্রে বিয়ে না দিলে সেই সন্তানেরই মনে হবে আমি এখনো ছাত্র। তাই বাবা-মায়ের কাছে থেকে খরচ নিয়ে প্রেম নামক শয়তানের খেলায় লিপ্ত হবে কিন্তু তার বিবেক একটুও বাধাগ্রস্ত হবে না।
নিজস্ব মতামত
বিয়ে একটি অত্যন্ত সুন্দর এবং পবিত্র কাজ। শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং সন্তান উৎপাদনের জন্যই বিয়ে নয়, বিয়ে দুটি পরিবারকে যেমন একত্র করে তেমনি দুটি পরিবারের আস্থার প্রতীক হয় বিয়ে। বাবা মায়েদের কাছে আমার প্রশ্ন, এত সুন্দর একটা ব্যবস্থা থাকার পরেও সমাজের কিছু কলুষিত এবং অযৌক্তিক নিয়মকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ের মত একটি সুন্দর কাজকে বিলম্বিত করে আসলেও কি আপনাদের কোন লাভ হচ্ছে? সমাজকে আমরাই তৈরি করি আমাদেরকে সমাজ নয়।
তাই প্রতিটা ঘর থেকেই প্রতিটা বাবা মায়ের কাছ থেকেই ভালো কাজের শুরু হোক এবং সমাজের পরিবর্তন হোক। বিয়ে হোক সহজ, বিয়ের ব্যাপারে সমাজের সকল সিদ্ধান্ত হোক সহজ এবং যুক্তিসঙ্গত।
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আর ভুল ত্রুটি হলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন। এ ধরনের আরো বেশ কিছু লেখা রয়েছে আমাদের ওয়েবসাইটে, পড়তে নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন। ধন্যবাদ।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url