চাকরিতে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত | সহকর্মীদের সাথে আচরণ
যারা বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকরি করেন তাদের দিনের একটি লম্বা সময় তাদের কর্ম ক্ষেত্রে থাকতে হয়। তাই কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ অবশ্যই ভালো হওয়া জরুরি। আর কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ তখনই ভালো হবে যখন সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।
একটি অফিসে প্রত্যেকটা সহকর্মীর আচরণ আপনার পছন্দ হবে এমনটি নয়। আবার আপনার আচরণ আপনার সহকর্মীরা সবাই পছন্দ করবে তেমনটিও নয়। তাই অফিসে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে চাইলে আপনার নিজেকে অথবা সহকর্মীর আচরণগত সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। আজকের এই লেখায় আসুন জেনে নেই সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক বা আচরণ কেমন হওয়া উচিত।
অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নাক না গলানো
অনেক ব্যক্তি আছেন বেশ মিশুক প্রকৃতির। তবে মিশুক বলেই যে আপনার নিজের ব্যক্তিগত কথা অন্যকে বলবেন অথবা অন্যের ব্যক্তিগত কথার মধ্যে আপনি নাক গলাবেন ব্যাপারটি মোটেও সে রকম নয়। আপনার কোন সহকর্মী যদি নিজে থেকে তাদের ব্যক্তিগত কথা আপনার সাথে শেয়ার করে, আপনি যদি বুঝতে পারেন যে আপনার সাথে তারা খুবই ফ্রি সেই ক্ষেত্রে আপনিও তাদের সাথে ফ্রি হিসেবে চলতে পারেন, নতুবা নয়। আপনাকে বুঝে শুনে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে হবে।
সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা
“হাসিমুখে কথা বলা” একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে চাকরি জীবনে আপনার ক্যারিয়ারে উন্নতি করার লক্ষ্যে। অফিসের বস থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত সবার সাথে চেষ্টা করবেন হাসিমুখে কথা বলার। অনেক সময় কাজের প্রেসারে সবার সাথে হয়তো সুন্দর করে কথা বলা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে পরবর্তীতে তাকে বুঝিয়ে সরি বলে নিবেন। এ আচরণটি ভবিষ্যতে আপনার প্রমোশন পেতে অনেকটাই সহায়ক হবে।
সহকর্মীদের ভুল ত্রুটি না ধারা
এক্ষেত্রে তিন বৈশিষ্ট্যের মানুষ দেখা যায়। প্রথমত যারা নিজে অত্যন্ত নিখুঁত কাজ করে, স্বভাবতই তাদের অন্যের ভুল ত্রুটি সহজে চোখে পড়ে এবং ভুল ধরিয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের চেয়ে নিজেকে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং দক্ষ ভাবে, তারাও অকারণে অন্যের ভুল ত্রুটি ধরে থাকে।
তৃতীয়তঃ এমন কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের কাজের প্রশংসার পরিবর্তে হিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়াই। কর্মক্ষেত্রে কোনোটি প্রযোজ্য নয়। মনে রাখতে হবে কেউ আপনার প্রতিটি কাজের সব সময় ভুল ধরলে আপনার কেমন অনুভূতি হবে।
তাই সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এই বদ অভ্যাসটি পরিহার করতে হবে। আপনার কোন সহকর্মী যদি আপনার কাছ থেকে কোন পরামর্শ চেয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি তার ভুল ত্রুটি গুলো সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলে পরামর্শ দিতে পারেন।
পরনিন্দা পরচর্চা না করা
পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র তথা সব জায়গাতেই অত্যন্ত ঘৃণিত এবং নিন্দনীয় একটি কাজ পরনিন্দা পরচর্চা করা। অনেকের স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ বদ অভ্যাসটি থাকে আবার অনেকে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য পরনিন্দা পরচর্চা করে থাকে।
যে কারণেই হোক আপনার যদি এই অভ্যাস থেকে থাকে তবে আজ থেকে এটিকে ত্যাগ করার চেষ্টা করুন। এই অভ্যাস থাকার ফলে আপনাকে সহকর্মীরা যেমন বিশ্বাস করবে না তেমনি কর্মক্ষেত্রে আপনাকে কেউ ভরসাও করতে পারবে না।
বসের কাছে কোন সহকর্মীর দুর্নাম না করা
অনেকেই মনে করেন বসকে খুশি রাখতে পারলে বসের মন মত চলতে পারলেই পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর তাই বসের চাটুকারিতা করার পাশাপাশি অন্যদের নামেও দুর্নাম করে তাদের ছোট করতে চায়। আপনি যদি সত্যিই আপনার ক্যারিয়ারের উন্নতি চান তবে আজকে থেকেই এ ধরনের মনোভাব ত্যাগ করুন।
প্রথমত, আপনার বস যদি অত্যন্ত সৎ মানুষ হয়ে থাকে তবে আপনার সম্পর্কে একটি খারাপ ধারণা জন্ম নেবে। তিনি মনে করতে পারেন আপনি যেহেতু অন্ন দিন আমি দুর্নাম করেন তাই আপনি আপনার বসের নামেও দুর্নাম অন্যদের কাছে করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আজ না হোক কাল আপনার এসব অপকর্মের কথা অফিসে সবাই জানতে পারবেই। শুধু শুধু অন্যের কাছে নিজেকে হেনস্থা করার কি দরকার বলুন?
বয়সে বড় এবং ছোট সহকর্মীদের সেই নজরে দেখা
ছোটবেলা থেকে আমরা শিখেছি বয়সে বড়দের সম্মান শ্রদ্ধা করতে হয় এবং ছোট দের স্নেহ করতে হয়। আপনার কর্মক্ষেত্রের জন্যেও সেই একই নিয়ম। কোন সহকর্মী আপনার মত কাজে দক্ষ নয় তাই বলে বয়সে বড় হওয়া সত্বেও আপনি তাকে অবহেলা করবেন বা অসম্মান করবেন এটি একদমই কাম্য নয়। আবার আপনার চেয়ে বয়সে জুনিয়র কোন সহকর্মী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। তাকে বাহবা দিয়ে প্রশংসা করুন, উৎসাহিত করুন। এতে আপনার প্রতি তার সম্মান বাড়বে।
প্রত্যেক সহকর্মীকে সঠিকভাবে সম্বোধন করা
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে হলে সঠিকভাবে সম্বোধন করাটা জরুরী। আপনার চাইতে সিনিয়র সহকর্মীদের সবাইকে ভাই/আপু বলে সম্বোধন করলে পছন্দ নাও হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আপনার জেনে নেওয়া উচিত তাকে ভাই/আপু বলবেন না কি স্যার/ম্যাডাম বলবেন।
আবার অনেক সময় দেখা যায় বয়সে ছোট সহকর্মীদের অনেকে অনুমতি না নিয়ে “তুমি” সম্বোধন করে থাকেন। এটিও ঠিক নয়। আপনার তাকে ‘তুমি’ করে বলতে ইচ্ছে হলে তার কাছে অনুমতি নিন। এতে আপনার সহকর্মীদের কাছে আপনার ব্যক্তিত্ব বাড়বে।
কারও উন্নতিতে হিংসা না করা
অফিসে কারো পদোন্নতি হলে অথবা ব্যক্তিগত আনন্দের খবর হলে হিংসা না করে তাকে শুভেচ্ছা জানান। এতে আপনার সম্বন্ধে আপনার সেই সহকর্মীর একটা ভালো ধারণা জন্মাবে এবং পরবর্তীতে আপনার বিপদ আপদে পাশে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
কেউ পিছিয়ে থাকলে তাকে অবজ্ঞা না করা
সবাই একরকম মেধাবী বা কর্মক্ষম হয় না। কেউ একটু বেশি পারে কেউ একটু কম পারবে এটাই স্বাভাবিক। যারা একটু কম কাজ পারে তাদেরকে অবজ্ঞা না করে বরং উৎসাহ দিন। সরাসরি তাকে অথবা অন্য কারো সামনে তার কাজের সম্পর্কে কটু কথা বলবেন না। কর্মক্ষেত্রে সিনিয়র জুনিয়র যে কোন সহকর্মীকে যে কোনো সময় প্রয়োজন হতে পারে।
অপরের সফলতায় প্রশংসা করুন
শুধুমাত্র পদোন্নতির ক্ষেত্রেই নয় মাঝেমধ্যে সহকর্মীদের ব্যক্তিগত কোন বৈশিষ্ট্যের জন্যও প্রশংসা করতে পারেন। প্রশংসা শুনতে প্রত্যেকটা মানুষের ভালো লাগে এবং প্রত্যেকটা মানুষের কিছু না কিছু ভালো গুণ থাকেই। প্রত্যেক সহকর্মীর ভালো দিকগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন এবং প্রশংসা করুন। এতে তাদের সম্পর্কে যেমন আপনার একটা ভালো ধারণা জন্মাবে ঠিক তেমনি আপনার সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে।
সর্বদা সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করা
শুধুমাত্র কর্ম ক্ষেত্রেই নয় সহকর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনের যেকোনো সমস্যা সমাধানে সহযোগিতার মনোভাব রাখতে হবে। অনেক সময় অনেক সহকর্মী সমস্যায় পড়লে বলতে হয়ত সংকোচবোধ করতে পারে কিন্তু আপনার উচিত সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করা।
সহকর্মীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া
কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো রাখতে সহকর্মীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধরুন একটি প্রজেক্টে আপনারা চার/পাঁচ জন আছেন, আপনি টিম লিডার। আপনার মনোভাবটা এরকম যে আপনি টিম লিডার হওয়ায় সবকিছু আপনি বোঝেন আর টিমের বাকি সদস্যরা কিছুই বোঝে না, তাদের মতামতের কোন গুরুত্ব নাই।
আরও পড়ুন
এখন অন্যান্য সহকর্মীর মতামতকে যদি গুরুত্ব না দিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন সে ক্ষেত্রে আপনার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না। তাদের মতামত যদি গ্রহণযোগ্য না হয় আপনি তাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এতে করে তারা তাদের নিজেদের ভুল যেমন বুঝতে পারবে তেমনি আপনার প্রতি তাদের আস্থা বাড়বে।
সহকর্মীর মনোভাব বুঝে কথা বলা
ধরুন আপনার এক সহকর্মী পারিবারিক কারণে বিষন্ন হয়ে অফিসে এসেছে। আর এদিকে আপনার পদোন্নতির খুশির খবর তাকে জানাতে গেছেন। স্বভাবতই সে আপনার খুশির খবরে খুশি হবে না। তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করুন এবং আপনার খুশির খবর দেয়ার আগে তার সমস্যার কথা জানতে চেষ্টা করুন, প্রয়োজন হলে তাকে সান্ত্বনা দিন।
মনে দ্বন্দ্ব না রেখে সরাসরি আলোচনা করুন
পরিবারের সদস্যদের মতো কর্মক্ষেত্রেও অনেকদিন যাবত একসাথে কাজ করতে গেলে বিভিন্ন কারণে মনোমালিন্য বা দ্বন্দ্ব হতে পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে কখনো কোন দ্বন্দ্ব বা মনোমালিন্য হলে সেটা মনে পুষে না রেখে সাথে সাথে সরাসরি তার সঙ্গে আলোচনা করুন। এতে করে তার সাথে আপনার সম্পর্ক যেমন ভালো থাকবে তেমনি কর্মক্ষেত্রের পরিবেশটাও ভালো থাকবে।
উপসংহার
অফিস বা কর্মক্ষেত্র আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় একটি স্থান। এখানে আমরা শখ করে বেড়াতে যাই না, আমাদের জীবন ধারণের জন্য চাকরি করার প্রয়োজন হয় বিধায় আমাদের অফিস বা কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। সেই কর্মক্ষেত্রের পরিবেশটি যদি আমরা আমাদের মতো করে মানিয়ে নিতে পারি তবে সেটি আমাদের কাজের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিবে।
আর যদি আমরা মানিয়ে নিতে না পারি তবে তার উল্টোটিও ঘটতে পারে। সে অফিসে হয়তো আমাদের কাজ করাটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে এবং এক পর্যায়ে হয়তো চাকরিটা আমাদের ছেড়ে দিতে হতে পারে। তাই সব জায়গাতে ভালো মন্দ নিয়েই আমাদের চলতে হয়।
পুরো লেখাটি এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উপরের বিষয়গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করেছি আপনাদের কর্ম ক্ষেত্রে পরিবেশ ঠিক রাখতে বা মানিয়ে নিতে হয়তো আমার কথাগুলো কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে। এরকম তথ্যবহুল আরো অনেক লেখা আমাদের ওয়েবসাইটি রয়েছে, পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url