শিশুর মানসিক বিকাশ | বাবা-মা হিসেবে যে ১০টি কাজ করবেন না

একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা মায়েরা শিশুদের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন থাকেন মানসিক সুস্থতার দিকে সেরকম নজর দেন না। বাবা-মা হিসেবে আমরা এমন কিছু আচরণ মাঝেমধ্যে করে বসি যেগুলো আমাদের অজান্তেই শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
শিশুর মানসিক বিকাশ বাবা-মা হিসেবে যে ১০টি কাজ করবেন না

আজকের এই লেখায় জানবো শিশুর মানসিক বিকাশে বাবা-মা হিসেবে কোন কাজগুলো করা একদমই উচিত হবে না। চলুন জেনে নেই সে বিষয়গুলো, আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে রাখুন

বর্তমানে আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি। আমাদের প্রয়োজনীয় সব কাজ প্রযুক্তির মাধ্যমে করতে হচ্ছে। বাসা বাড়ির বৈদ্যুতিক বিল দেওয়া শুরু করে অনলাইনে টিকিট কাটা পর্যন্ত সবকিছুই প্রযুক্তির মাধ্যমে করছি আর এই প্রযুক্তির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন মোবাইল ল্যাপটপ ট্যাব সহ বিভিন্ন গেজেট। 

আর এই গেজেটের প্রতি আমাদের সন্তানরা দিনে দিনে ঝুঁকে পড়ছে বাচ্চা খেতে না চাইলে বাচ্চাকে শান্ত করতে চাইলে অনেক বাবা-ময় তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন। এইভাবে তারা মোবাইল ফোনে কার্টুন দেখতে অভ্যস্ত হয় একদিকে যেমন তাদের চোখের ক্ষতি হয় অন্যদিকে তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। 
মোবাইলের প্রতি আসক্তি বাড়ায় বাচ্চারা বাইরে যেতে চায়না অথবা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের সুস্থ্য দ্বারা অব্যাহত রাখতে ইলেকট্রিক ডিভাইসকে দূরে রেখে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানো যেতে পারে, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।

বকাঝকা করবেন না

বাচ্চারা বিশেষ করে ৫-৬ বছর পর্যন্ত খুব চঞ্চল থাকে, তারা দুষ্টামি করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সব সময় তাদেরকে বকাঝকা করবেন না। ফলে তারা যেমন আপনাকে ভয় করবে এবং ভয় করার ফলে আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে, আপনাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হবে ঠিক তেমনি বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনার বকাঝকা কে তারা আমলে নিবে না। 

ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে আপনাদের শাসন না মানার একটা প্রবণতা চলে আসবে। তাই বকাঝকা করার পরিবর্তে তাদেরকে আদর করুন, বুঝিয়ে বলুন, চকলেট বিস্কুটের প্রলোভন দেখান দেখান।

সন্তানের সামনে নিজেরা ঝগড়া করবেন না

বাচ্চাদের সামনে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার মত গুরুতর ভুল করে ফেলেন বাবা মায়েরা। এতে করে সন্তানের মানসিক বিকাশে কি ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় অনেক বাবা-মা সেটা খেয়াল করেন না। 

সন্তানের সামনে বাবা-মায়ের ঝগড়া করার সবচেয়ে বড় কুফল হলো সন্তান ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া করা শিখে যায়, তাদের মধ্যে ঝগড়া করার একটা প্রবণতা চলে আসে এবং অন্যদের সম্মান করার বিষয়টি তারা শিখে ওঠে না। তাছাড়া বাবা-মার দেখাদেখি তাদেরও বড় হওয়ার পর বৈবাহিক জীবনে এসে সেই ভাবে ঝগড়া করার সম্ভাবনা থেকে যায়।

সব সময় শাসন করবেন না

সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের এটি আরেকটি ভুল অনেকে হয়তো বলবেন শাসন না করলে সন্তান বেয়াদব হতে পারে। হ্যাঁ, অবশ্যই শাসন করবেন। শাসন ছাড়া কোন সন্তানই সুস্থভাবে নৈতিকতা নিয়ে এবং বিবেক সম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। তাই বলে শাসনেরও একটা পদ্ধতি রয়েছে। 

সন্তান কোন ভুল করলে আগে তাকে বুঝিয়ে বলুন, কথা না শুনলে তাকে ধমক দিন, ধমকও যদি কাজ না হয় বিভিন্ন রকম ভয় দেখান, তাতেও যদি কাজ না হয় সর্বশেষ পর্যায়ে গায়ে হাত তোলেন কিন্তু সেটা অবশ্যই আলতোভাবে। 

তাকে শোধরানোর সময় দিতে হবে, আপনি কোন রকম সুযোগ না দিয়েই যদি গায়ে হাত তোলেন সেটি অবশ্যই বাচ্চার মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কথায় কথায় বাচ্চাদের আচরণে রেগে গেলে, বাচ্চার গায়ে হাত তুললে তারাও বাইরে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলার সময় কথায় কথায় মারামারি করবে।

তুলনা করা বন্ধ করুন

অনেক বাবা-মা আছেন যারা তাদের সন্তানকে শান্ত করার জন্য, জিদ থামানোর জন্য, খাওয়ানোর জন্য বা যে কোন ক্ষেত্রে অন্য বাচ্চার সাথে তুলনা করে। এটি একদম করা উচিত নয়। কারণ আপনার সন্তান ছোট হলেও তার মনে কিন্তু একটা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সে মনে করবে আপনি তাকে খারাপ বলছেন এবং অন্য বাচ্চার প্রশংসা করছেন। 

এতে করে আপনাদের প্রতি তার একটা খারাপ ধারণা যেমন জন্মাবে ঠিক তেমনি তার মনে হিংসার মনোভাব কাজ করা শুরু করবে। বরং বাবা-মা হিসেবে উল্টো কাজটা করতে পারেন। সন্তানকে শান্ত করতে এভাবে বলা যেতে পারে- তুমি সবার চেয়ে ভালো, তুমি ভালো বলেই তো কথা শুনবে আর তুমি যদি কথা না শুনো তাহলে তুমি পচা হয়ে যাবে। এভাবে বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে হবে কি বলে বা কি করে, কিভাবে সঠিক এবং সুস্থ উপায়ে বাচ্চাকে শান্ত করা যায়।

একদম মিথ্যা বলবেন না

বাবা মায়েরা হওয়ার হামেশাই বাচ্চাদের সাথে মিথ্যা বলে থাকে। যেমন ধরুন বাচ্চা খাবেনা জেদ করছে তাই বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য বা শান্ত করার জন্য বাবা মা বলে দিলেন তুমি ভাত খেয়ে নাও তাহলে তোমাকে একটা চকলেট দিব। 

কিন্তু খাওয়ার পরে যদি চকলেট দেওয়া না হয় বাচ্চাকে, তখন তারা প্রথমদিকে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝে যায় যে তাদের বাবা-মা তাদের সাথে মিথ্যাচার করছে। এর ফলে বাবা-মায়ের কথায় তারা আর বিশ্বাস খুঁজে পাবে না। বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে কখনো মিথ্যা আশ্বাস দেবেন না এবং নিজেদের মধ্যে মিথ্যা বলার অভ্যাস থাকলে সেটা অবশ্যই পরিহার করুন।

নিজের মতামত শিশুর উপর চাপিয়ে দিবেন না

ধরুন পরিবারের সবাই মিলে আপনারা বাইরে ঘুরতে যাবেন। আপনার মেয়ে একটি জামা পড়তে চাইছে কিন্তু আপনি সে জামাটা পড়তে নিষেধ করে আপনার পছন্দের একটি জামা জোর করে তাকে পরতে বলছেন। এভাবে আপনার মতামত আপনার সন্তানের উপর জোর করে চাপিয়ে দিবেন না। 


আরও পড়ুন

মেয়ের পছন্দ করা জামাতে যদি কোন সমস্যা থাকে যেমন ছেঁড়া, রং নষ্ট হয়ে যাওয়া বা অনেক বেশি পুরনো এ ধরনের কোন সমস্যা থাকলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। তবে কোন সমস্যা না থাকার পরেও আপনার ব্যক্তিগত কারণে যদি আপনি জামাটিকে পছন্দ না করেন তবে অবশ্যই আপনার সন্তানের উপর জোর করবেন না।

শিশুদের সামনে কখনোই এডাল্ট মুভি/ নাটক দেখবেন না

ছাত্র অবস্থায় আমরা মুভি দেখতে পছন্দ করি এবং মুভি দেখে আমরা অভ্যস্ত। দেশি, বিদেশি, কমেডি, adult বিভিন্ন রকম মুভি দেখার অভ্যাস আমাদের থেকে যায়। এরপরে বিয়ে হয়। সন্তান জন্মের পরে সন্তান একটু বড় হয় তখনও যদি আমরা সেই অভ্যাস ত্যাগ না করি বিপত্তি তখনই বাধে। সন্তানের সামনেও আমরা অনেকেই এডাল্ট মুভি বা ওয়েব সিরিজ দেখে থাকি। 

অনেক বাবা মা মনে করেন বাচ্চা তো এখনো ছোট ও কিছু বুঝবে না। আবার অনেকে বাবা-মা নিজেদের মধ্যে সন্তানের সামনে চুমু খান এটাও ঠিক নয়। প্রাইমারি লেভেলের অনেক স্কুলে বাচ্চাদের তাদের সহপাঠীদের চুমু খাওয়ার নজির এখন অনেক রয়েছে। ছোট অবস্থায় এমন কর্মকাণ্ড দেখতে মজা লাগলেও পরবর্তীতে এই ঘটনাগুলোর প্রভাব ভালো হবে না।

শিশুদের সামনে কখনোই অন্যের গীবত করবেন না

সব পরিস্থিতিতে সবার জন্যই গীবত করা একটি নিন্দনীয় কাজ। ধরুন আজকে অফিসে আপনার কলিগের কোন আচরণ খুব বিরক্ত হয়েছেন, বাসায় এসে কলিগের কথাটাই বলছেন খুব খারাপ ভাবে। আপনি বিরক্ত প্রকাশ করছেন কিন্তু আপনার সন্তান সেটা শুনে ভাববে যে এই ভাবেই হয়তো বলতে হয় কারো উপর বিরক্ত হলে। বাবা মার এমন আচরণে বাচ্চাদের শিশু কাল থেকেই গীবতের চর্চা শুরু হয়ে যায়। তবে শুরুটা হয় নালিশের মধ্য দিয়ে।

অন্যকে গালিগালাজ করবেন না

অন্যকে গালিগালাজ করা আমাদের বাঙ্গালীদের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের মনের মত না হলে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু হলেই আমরা সহজেই গালি দিয়ে বসি। মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারে খুব সস্তা গালি হচ্ছে “শালা”। আর একটু উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ গালি দেয় ইংরেজিতে। যাইহোক বাংলা অথবা ইংরেজিতে হোক না কেন গালি সব সময় পরিত্যাজ্য।

উপসংহার

প্রতিটি বাবা-মার কাছে তার সন্তান অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি বাবা-মাই চায় তার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে বড় হোক কিন্তু সন্তানকে সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যা যা করা দরকার অনেক বাবা-মাই হয়তো সেটা খেয়াল করেন না। মিথ্যা বলা, গীবত করা, অন্যকে গালি দেয়া, প্রতারণা করা এই ধরনের খারাপ অভ্যাসগুলো আগে নিজেদের মধ্যে থেকে দূর করতে হবে। 
বাবা-মার মধ্যে যদি এই খারাপ অভ্যাসগুলো থেকে থাকে তাহলে সন্তান বিবেক সম্পন্ন মানুষ হবে এ আশা কি করা যায়? স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা যেমন কঠিন ঠিক তেমনি সন্তান জন্ম দেয়ার পরে সন্তানকে বিবেক সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা অনেক কঠিন। তাই সন্তানের শিশুকাল থেকেই বাবা-মা হিসেবে আমাদের সচেতন হয়ে চলাফেরা করা উচিত।

অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি লেখাটি এতক্ষণ ধরে পড়ার জন্য। ভুল ত্রুটি হলে মার্জনীয়। পরিচিতদের সাথে লেখাটি শেয়ার করার অনুরোধ থাকলো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url