ড. মুহাম্মদ ইউনুস | তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা | পর্ব ০২
ইউনুস দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য নিজেকে যেভাবে উৎসর্গ করেছেন এবং সারাটা জীবন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ এর মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করেছেন সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আমরা অভিভূত হতে বাধ্য। শুধু ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাননি তিনি লিখেছেন গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বই এবং পেয়েছেন বহু সম্মাননা।
আজকের এই লেখায় চলুন জেনে নেই ইউনুস কিভাবে একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে আজকে গোটা বিশ্বের দরবারে উল্লেখযোগ্য একজন উদ্যোক্তা তে পরিণত হয়েছেন যার বিভিন্ন তত্ত্ব আজ বিভিন্ন দেশ অনুসরণ করছে।
লেখক ইউনুস
লেখক হিসেবেও মুহাম্মদ ইউনূসের পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়েছি আমরা। ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, সামাজিক ব্যবসা, সামাজিক পুঁজি ইত্যাদি বিষয়ের উপর তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন এবং এগুলোর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পেয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কথা আসলে গ্রামীণ ব্যাংকের কথা অবশ্যই আসবে। কারণ মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক এই বিষয় দুটো নিবিড় ভাবে একে অপরের সাথে জড়িত। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক একটি স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসেবে তার কার্যক্রম শুরু করে। তবে বাংলাদেশের পাঁচটি অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংকের একটি হল গ্রামীণ ব্যাংক।
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং সামাজিক উন্নয়ন ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ ব্যাংক মূলত গ্রামের দরিদ্র অসহায় নারীদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক এই ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জন্য গ্রামের পাঁচজন করে একটি দল গঠন করে এবং সেই দলকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের হার ৯৮ শতাংশ। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীর সংখ্যা ১৮,২০৩ জন। মোঃ ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও এ ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে তিনি নেই। চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. একেএম সাইফুল মজিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব রয়েছেন নূর মোহাম্মদ।
বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ ভূমিকা রাখায় গ্রামীণ ব্যাংক এবং মুহাম্মদ ইউনুস যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশের কোন শ্রেণীতে মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে কিছু পড়ানো না হলেও পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ সমূহে তাদের পাঠ্যপুস্তকে মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে পড়ানো হয়। গ্রামীন ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ অর্থায়ন প্রকল্পের মডেলটি যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের প্রায় ৪০ টি দেশে অনুসৃত হচ্ছে।
যেভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের উৎপত্তি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক এর দায়িত্ব পালন করার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ছোট অনুন্নত জোবরা গ্রামে মাঝেমধ্যে ইউনুস ঘুরতে যেতেন। গ্রামের বেশ কিছু দরিদ্র পরিবারের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি আবিষ্কার করেন ক্ষুদ্রঋণ বা অল্প পরিমাণ ঋণ একটা মানুষের বা পরিবারের পরিবর্তন করতে সক্ষম।
মুহাম্মদ ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক গঠনের কারণ সম্পর্কে বলেছিলেন এভাবে- “১৯৭৪ সালে দেশে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছিল এবং খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছিল না। এটা ছিল চারপাশে দেখা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। অর্থনীতির যে মনোমুগ্ধকর তত্ত্ব পড়ায় এখানে সেটির অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ, সেই তত্ত্বগুলো সেই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত মানুষের কোন কাজে আসে না। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি কিছু মানুষের জন্য কিছু কাজে আসতে পারি কিনা।”
গ্রামের বেশ কিছু দরিদ্র পরিবারের মহিলারা পাশের তৈরি বিভিন্ন আসবাব বানাতে পারতো। কিন্তু তাদের বাঁশ কিনতে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হতো যার ফলে তাদের হাতে লাভের টাকা আসতো না। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক ঋণ ক্লাবের ঝুঁকির কারণে যুক্তিসঙ্গত সুদে তাদের ছোট ছোট ঋণ দিতে অসম্মতি জানায়।
এই পরিস্থিতি দেখে ইউনুস বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে এসব দরিদ্র পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন করতে এই ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ একটি কার্যকর ব্যবসায়িক মডেল হতে পারে। এরপর পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য তিনি তার নিজের পকেটের অর্থ থেকে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ দেন গ্রামের ৪২ জন মহিলাকে তৎকালীন সময়ে যার প্রতিটি ঋণে ৫০ পয়সা লাভ করেন। এ গবেষণা থেকে তিনি তার ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সফলতার সূচনা করেন।
ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সফলতার কথা জানার পর ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে সরকারি জনতা ব্যাংক থেকে জোবরা গ্রামের দরিদ্রদের ঋণ দেয়ার উদ্দেশ্যে ইউনুস কিছু ঋণ নেন। আসলে সেই সময় ইউনুস তার প্রকল্প পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কার্য পরিচালনা করছিলেন।
১৯৮২ সাল পর্যন্ত ইউনুসের এ প্রকল্পের অধীনে ঋণ গ্রহীতা ছিল প্রায় ২৭০০০ জন এবং ১৯৮৩ সালের ১ অক্টোবর এই প্রকল্পটি দরিদ্র মানুষের অর্থায়নের উৎস হিসেবে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর নামকরণ করা হয় “ভিলেজ ব্যাংক” বা “গ্রামীণ ব্যাংক”।
ইউনুস সেন্টার
ইউনুস সেন্টার ঢাকায় গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে অবস্থিত। বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কিত বিষয়গুলোর জন্য থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে, দারিদ্র্য বিমোচন ও স্থায়িত্বের জন্য কাজ করে। বর্তমানে এটির সভাপতি তো করছেন মুহাম্মদ ইউনুস এবং নির্বাহী পরিচালক মিসেস লামিয়া মোর্শেদ। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ইউনুস যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার জয় লাভ করার পরে “ইউনুস সচিবালয়” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।
এটির উদ্দেশ্য ছিল ইউনুসের বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার প্রচার এবং বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসায় আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ওয়ান স্টপ রিসোর্স সেন্টার হিসেবে কাজ করা। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে এটির নামকরণ করা হয় “ইউনুস সেন্টার”।
বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দারিদ্র মুক্ত বিশ্ব অভিযান পরিচালনা করা, গবেষণা ও প্রকাশনা করা, সামাজিক ব্যবসা পর্যালোচনা করা, গ্লোবাল সোশ্যাল বিজনেস সামিট করা, একাডেমিক প্রোগ্রাম তৈরি করা ইত্যাদি।
ক্ষুদ্রঋণ
যে সহজ এবং মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনুস আজ বিশ্ব বিখ্যাত সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। বাংলাদেশে তাঁর দারিদ্র্য বিমোচনের মূল চাবিকাঠি ছিল ক্ষুদ্র ঋণ। ক্ষুদ্র ঋণ হচ্ছে দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ও দরিদ্র উদ্যোক্তাকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রদত্ত ঋণ সুবিধা। বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাংকে এই ধরনের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের কোন ব্যবস্থা নেই।
সেই সব ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে মোটা অংকের ঋণ নিতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে বেশকিছু কঠিন শর্ত মানতে হয় গ্রাহকদের। তবে গ্রামের হত-দরিদ্র, প্রান্তিক অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের এসব শর্ত মেনে মোটা অংকের ঋণ নেওয়া একদম অসম্ভব। তাই গ্রামীণ ব্যাংক একদমই সহজ শর্তে এবং বিনা জামানতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে থাকে দরিদ্র অসহায় ব্যক্তিদেরকে তাদের নিজস্ব কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে।
গ্রামীণ ব্যাংক সাধারণত গ্রহীতার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১০০০ টাকা থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দিয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক পরীক্ষামূলক ভাবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিশেষায়িত ব্যাংক যথা কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং প্রায় ৮০০ এর বেশি এনজিও দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু রেখেছে।
থ্রি জিরো কনসেপ্ট
বিশ্ববাসীর কাছে সব সময় সমাদৃত থাকলেও বেশ কিছু বছর ধরে এই “থ্রি জিরো” ধারণাটি এতই গ্রহণযোগ্য হয়েছে যে মুহাম্মদ ইউনুস নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছেন। তার এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু দেশ ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বিভিন্ন দেশ এই চিন্তা দর্শনের আদলে সাজাচ্ছেন তাদের সামাজিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম। এই ৩০ কনসেপ্ট টি কে কিভাবে আর্থসামাজিক কাজে লাগানো যায় সে ধারণা শেয়ার করেছেন তিনি তার “A World of Three Zeroes” বইতে। চলুন জেনে নেই “থ্রি জিরো” কনসেপ্ট টা আসলে কি!
দারিদ্রতা: ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা এবং নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ও আর্থিক স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে যেকোনো দেশের দারিদ্রতা কমিয়ে একদম শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে।বেকারত্ব: ব্যাপক হারে উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব কমিয়ে একদম শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে।কার্বন নিঃসরণ: বর্তমান পৃথিবীতে বসবাসের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো বায়ুমন্ডলে কার্বনের আধিক্য। এর ফলে দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের মত মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। গোটা বিশ্বকাপে জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে চাহিদার যোগানোর জন্য কলকারখানা বেরিয়ে চলেছে এবং কলকারখানা থেকে নির্গত ধোয়া আমাদের বায়ুমণ্ডল কে দূষিত করছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে বায়ুমন্ডলে কার্বনের নিঃসরণের হার শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে।
দারিদ্রতা, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ দূরীকরণ করে পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে তোলার এই ধারণাই হচ্ছে “থ্রি জিরো” কনসেপ্ট।
সম্মাননা
- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুহাম্মদ ইউনুস কে প্রায় ৪৮ টি “সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রী” দেয়া হয়।
- দারিদ্র বিমোচনে অসামান্য অবদানের কারণে শান্তিতে নোবেল জয়ী ইউনুসকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা “কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল” দেয়া হয়।
- ৫ মে ২০১৩ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্মেলনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনুস কে “আজীবন সম্মাননা পুরস্কার” প্রদান করা হয়।
- এছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান এবং তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য আমেরিকার আরেকটি সম্মানীয় পুরস্কার “প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড” পেয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, পুরো পৃথিবীতে মাত্র ১২ জন মহৎ ব্যক্তি রয়েছেন যারা বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক তিনটি পুরস্কার- আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড, কংগ্রেসনাল অ্যাওয়ার্ড এবং নোবেল পেয়েছেন। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসা সহ আরো অনেকে। আর এই ১২ জন ব্যক্তির মধ্যে একজন হলেন আমাদের গর্ব মুহাম্মদ ইউনুস।
- বর্তমানে পুরো বিশ্বে প্রায় ৩০ টিরও বেশি দেশে প্রায় ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ রয়েছে যেগুলোতে ইউনুস এর নামে বিভিন্ন সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার চালু করা হয়েছে।
- বিশ্বের প্রায় ৩০ টি দেশে তার লেখা বিভিন্ন বই অনুবাদিত হওয়ার পাশাপাশি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্ট এ তার বেশ কিছু বইয়ের নাম উঠে এসেছে।
- কানাডা সরকার জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের সপ্তম গ্রেডে ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছে। নিয়মিত তার জীবনী পড়ানোর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইউনুসের মত উদ্যোক্তা হওয়ার শিক্ষা দেয়।
- এছাড়া জাপানের হাই স্কুলের ইংরেজি টেক্সট বইয়ে ইউনুস এর উপরে একটি চ্যাপ্টার রয়েছে। ফলে সেখানকার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ইউনুস কে চিনলেও আমাদের দেশের স্কুল পরুয়া ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই ইউনুস কে চেনেনা কারণ আমাদের দেশের পাঠ্য বইয়ে ইউনুস সম্পর্কে তেমন কিছুই নেই।
- আমাদের দেশের মানুষ ইউনূসের কদর না বুঝলেও বিদেশীরা ঠিকই বুঝেছে। আর তাইতো ২০১২ সালে গ্লাসগো ক্যালেডনিয়ান ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করা হয় তাকে। এর জন্য অবশ্য ব্রিটিশ সরকারকে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয় কারণ সেখানে সংবিধানে ছিল ব্রিটিশ নাগরিক ছাড়া ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হতে পারবে না। বাঙ্গালী হওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার সংবিধান চেঞ্জ করে তারপরে ইউনুসকে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করেন। এত বড় সম্মান বিশ্বের আর কয়জন ব্যক্তি পেয়েছেন আমার জানা নেই।
- অলিম্পিকের মত বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক প্রতিযোগিতার আসরে প্রধান অতিথি অর্থাৎ অলিম্পিকের মশাল বাহকের সম্মান পেয়েছেন আমাদের ড. ইউনুস। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে অলিম্পিকের হোস্ট হয়।
- বিশ্বের ইতিহাসে Olympic Laurel মাত্র দুইজন ব্যক্তি রয়েছেন যার মধ্যে একজন মুহাম্মদ ইউনুস।
- সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের মূল থিম ডিজাইন করা হয়েছে ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বকে কেন্দ্র করে। অলিম্পিক গেমস এর ওয়েবসাইটের টাইটেল পেজে বিশ্বের অনেক বিখ্যাত এবং আলোচিত ব্যক্তির মধ্য থেকে শুধুমাত্র ইউনূসের ছবি দেখতে পাওয়াটা সত্যি আমাদের অনেক গর্বের বিষয়।
- ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক আয়োজিত বিশ্বের টপ ১২ জন উদ্যোক্তার একটি লিস্ট তৈরি করা হয়েছিল যার মধ্যে ইউনুস ছিলেন। এই লিস্টে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বিল গেটস, স্টিভ জবস সহ আরো অনেকে।
- গোটা বিশ্বের লিডিং ইনটেলেকচুয়াল দের নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হলে টপ ৫ এর মধ্যে আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর নাম থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা
অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত লেখক এবং সাংবাদিক ফেলিসিটি ম্যাকলিন এর মতে মুহাম্মদ ইউনুস এর বর্ণাঢ্য জীবন, তার চিন্তাধারা, কার্যাবলী, তার উদ্যোগ এবং দক্ষতা থেকে নিচের পাঁচটি বিষয় বর্তমান তরুণ প্রজন্ম খুব ভালোভাবে শিখতে পারে।
ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করুনসফল উদ্যোক্তাদের আরেকটি বিশেষ গুণ হলো অন্যরা যেভাবে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করে সফল উদ্যোক্তারা সেই ভাবে নয় বরং অনেক কঠিন ভাবে, ভিন্নভাবে স্বপ্ন দেখার সাহস করে। নিউইয়র্ক টাইম সেট একটি সাক্ষাৎকারে ডক্টর ইউনুস বলেছিলেন- তার কাজ তাকে সফল করবে কিনা তা না জানা সত্ত্বেও তিনি পিছপা হননি এবং ব্যর্থতাকে ভয় পাননি।তিনি বলেন “আমি যেটা সঠিক মনে করেছি সেটাই করেছি এবং সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি পুরো বিশ্ব আমাকে এটার বিপরীতে কথা বলেছিল তারা বলেছিল এটি একটি ইউটোপিয়ান ধারণা, এটা বেশিদিন টিকবে না। আমি তাই করলাম যেটা আমার কাছে সঠিক মনে হলো এবং আমি আমার উদ্দেশ্যে অবিচল থাকলাম।”আপনার চারপাশের সাথে সংযোগ রক্ষা করুনএকটি নির্দিষ্ট স্থান বা সাংস্কৃতির সাথে পরিচিতি একজন সামাজিক সফল উদ্যোক্তার সফলতার সাথে সংযোগ রক্ষা করে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন তিনি আশেপাশের মানুষজন এবং সমাজের চিত্র ভালোভাবে অনুভব করেন।উদাহরণস্বরূপ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ যখন দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছিল তখন মোঃ ইউনুস একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা করেন এবং মিডিল স্টেশনে স্টেট ইউনিভার্সিটি সহকারী অধ্যাপক এর ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি বাংলাদেশ নিউজ লেটার প্রকাশ করেন।বড় চিন্তা করুনঅশোক প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও বিল ড্রেটন মনে করেন দারিদ্র দরিদ্র মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয় না বরং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মব্যর্থতার কারণেই দারিদ্রতার উৎপত্তি হয়। ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে গ্রামের দরিদ্র জন্য গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়ার জন্য রাজি করেছিলেন এবং এটি ছিল তাদের জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার মূলক পদক্ষেপ।ডক্টর ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংক আজ কৃষি থেকে যোগাযোগ পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে অর্থাৎ ডঃ মোঃ ইউনুস আগে কখনোই ভাবেননি যে তার গ্রামীণ ব্যাংক আজ এ অবস্থানে এসে পৌঁছাবে। তাই চিন্তা এবং স্বপ্ন দেখতে হবে অনেক বড়।নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়াযে বিষয়টি ইউনুসকে একজন ব্যতিক্রমী সামাজিক সফল উদ্যোক্তা করে তোলে সেটি হল তিনি একজন সত্যিকারের নেতা একজন দক্ষ কারিগর যার কাজ বিশ্বব্যাপী দারিদ্রতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধু তাই নয় তিনি যে শুধু নিজের দরিদ্রতার বিপক্ষে কাজ করেন তাই নয় পুরো বিশ্বকে দেখে দেন কিভাবে দরিদ্রতা দূরীকরণ করতে হয়। দরিদ্র দুটি করণ করতে কোন পথে গুতাবে তাও তিনি দেখিয়ে দেন।সহানুভূতির গুরুত্বসহানুভূতি হল অন্যদের অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ক্ষমতা এবং সেই অনুযায়ী একজন তার কার্যকলাপ পরিচালনা করবে। ইউনুস তার জীবনের মধ্যে দিয়ে যেটি খুঁজে পেয়েছেন তা হল মানুষ হিসেবে যতটা আলাদা তার চেয়ে অনেক বেশি একই। এই সহানুভূতির অনুভূতিগুলো যদি থাকে তবে একজন সফল উদ্যোক্তা সহজে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারেন।
উপসংহার
“প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস” শুধু একটি নাম নয়, একটি লাইব্রেরী। এই নামের ভিতরে নিহিত রয়েছে অসংখ্য জ্ঞান, উৎসাহ, উদ্দীপনা, অনুপ্রেরণা, সততা, নিষ্ঠা, উৎসর্গ করার মত মনোবল ইত্যাদি। মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে আমরা যতই বলি বা লিখি না কেন তা আসলে শেষ হবে না। উনি আস্তিক নাকি নাস্তিক, উনি সুদ নেন না নেন না, উনি ব্যক্তি জীবনে কেমন ছিলেন আসলে এই প্রশ্নগুলো একদমই অমূলক এবং অযৌক্তিক।
কেননা সারা জীবন ধরে উনি কাজ করে গেছেন শুধুমাত্র বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, নিজের সুনাম কেনার জন্য উনি কিছুই করেন নাই। গোটা বিশ্বের দরবারে ইউনুস বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেন এবং গোটা বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে চেনে ইউনূসের কারণে। ইউনূসের সারা জীবনব্যাপী জনহিতকর কার্যাবলী দেখে বা শুনে তাকে শুভ কামনা এবং কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আসলে আমাদের আর কোন উপায় নেই।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url