আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মুসলিম বা অমুসলিম যাই হোক না কেন আল আফসা মসজিদ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। তবে মুসলিমদের কাছে আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে কতটা অপরিসীম তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
"ইসলামিক তথ্য" এর আজকের পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করব আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব। শুধু ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে নয় আল-আকসা মসজিদ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে প্রার্থনা এবং গভীর বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। আল আকসা মসজিদ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বেন।
আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কিবলা নির্ধারণের দিক দিয়ে মুসলমানদের প্রথম কেবলা ধরা হয় মসজিদুল আকসা কে। তবে কাবা শরীফ নির্মাণের পরে মসজিদুল আকসা থেকে সরিয়ে কিবলা নির্ধারণ করা হয় কাবা শরীফকে। তবে মুসলমানদের ধর্মীয় গুরুত্ব অনুযায়ী মসজিদুল আকসার অবস্থান তৃতীয়, মদিনা এবং মক্কার পরে।
আল আকসা মসজিদ মসজিদুল হারাম থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এদিকে মসজিদুল আকসা বলেও উল্লেখ করা হয়। আল আকসা মসজিদকে আল কুদস, বায়তুল মুকাদ্দাস, মসজিদে আকসা, হারাম আল শরীফ, কিবলী মসজিদ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।
১৯৬৭ সালে তৃতীয়বারের মতো আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল জেরুজালেম দখল করে নেয়ায় আল-আকসা মসজিদ কে নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। দখলের পরে ইসরাইলিরা ষড়যন্ত্র করে আল আকসা মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে আরব দেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্ব বিক্ষোভ করে এবং বিক্ষোভের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ওআইসি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবেই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী আল আকসা মসজিদ। তাহলে চলুন আর কথা না বাড়িয়ে জেনে নেই আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
আল-আকসা মসজিদ সম্পর্কে
প্রথমে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত, আল আকসা মসজিদ বলতে কোন একক মসজিদকে বোঝানো হয় না। ১৪৪ একরের উপর বিভিন্ন স্থাপনা সহ পুরো এলাকাটিকে আল আকসা নামে অবহিত করা হয়। পুরো আল-আকসা এলাকার মধ্যে বিভিন্ন আঙ্গিনা, মিহরাব, মসজিদ, গম্বুজ, আজানের স্থান, কূপ সহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে।
আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছবিতে সোনালী বড় গম্বুজ বিশিষ্ট যে মসজিদ দেখে থাকি সেটিকে বলা হয় “কুব্বাতুস সাখরা” বা “ডোম অফ দ্য রক”। এটি নির্মাণ করেন ৭২ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা হযরত আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান। আল আকসা এলাকার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত “কিবলি মসজিদ” যেটি নির্মাণ করেছিলেন খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক।
এছাড়াও রয়েছে “কুববাত আস সিলসিলা”, “কুব্বাত আন নবী” মসজিদ। সবগুলো মসজিদ একসাথে মিলে “হারাম আল শরীফ”। নির্মাণের সময় আল আকসা কম্পাউন্ডে ১৫ টি গেট থাকলেও বর্তমানে ব্যবহৃত হয় দশটির মতো।
আল আকসা মসজিদ কোথায় অবস্থিত
ফিলিস্তিনের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত পবিত্র জেরুজালেম নগরীর পূর্ব প্রান্তের পাহাড় চূড়ায় আল আকসা মসজিদ অবস্থিত। আল আকসা মসজিদ এর আশেপাশের এলাকাটি অত্যান্ত স্মৃতি বিজড়িত একটি স্থান এবং পুণ্যভূমি কারণ এখানে অনেক নবী রাসূলগণ এসেছেন, নামাজ পড়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকের সমাধিও রয়েছে। নবী (সাঃ:) এরশাদ করেছেন “জেরুজালেমে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কোন নবী রাসূল সালাত আদায় করেননি এবং কোন ফেরেস্তা দাঁড়াননি।” (তিরমিজি)
আল আকসা মসজিদের নির্মাণ ইতিহাস
অনেকের ধারণা মতে হযরত সুলাইমান (আ:) আল আকসা মসজিদের নির্মাতা। তবে সঠিক তথ্য হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে আল-আকসা মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা হয়। এর পরবর্তী বেশ কয়েক বছরের মধ্যে কিছু ভূমিকম্পের ফলে খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটিকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এরপরে আবারও বিভিন্ন সময়ে সংস্কার কাজ চলতে থাকে।
বেশ কিছু মুহাদ্দিসের মতে আল আকসা মসজিদ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় সর্বপ্রথম আদম (আ:) অথবা ফেরেশতাদের মাধ্যমে। কাবা শরীফ নির্মাণের ৪০ বছর পরে আল আকসা মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইয়াকুব (আ:) আল আকসা মসজিদের পুনঃনির্মাণ শুরু করেন।
এবং এর প্রায় এক হাজার বছর পরে দাউদ (আ:) পুনরায় আল আকসা মসজিদের পুনঃনির্মাণ করেন। হযরত দাউদ (আ:) পুনঃনির্মাণ কাজ শেষ করতে না পারায় তার ছেলে হযরত সুলাইমান (আ:) আল-আকসা মসজিদের সংস্কার কাজ শেষ করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলাইমান (আ:) কে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন জিনদের বশ করার।
জিনদের মাধ্যমে হযরত সুলাইমান (আ:) অনেক কঠিন কঠিন কাজ সাধন করেছিলেন যেমন সমুদ্রের তলদেশ থেকে মনি মুক্ত সংগ্রহ করে আনা, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা। এরই ধারাবাহিকতায় হযরত সুলাইমান (আ:) আল আকসা মসজিদের সংস্কার কাজ জিনদের দিয়ে করিয়েছিলেন যেটি এখনো দৃশ্যমান।
আল আকসা যে কারণে মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান সবার কাছে প্রিয়
মুসলিম বিশ্বের কাছে আল আকসা মসজিদ গুরুত্ব পূর্ণ সেটা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। আল আকসা মসজিদকে শুধু মুসলিম বিশ্ব নয় খ্রিস্টান এবং ইহুদীরাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে। আল-আকসা কম্পাউন্ডের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে আল বুরাক প্রাচীর বা ওয়েস্টার্ন ওয়াল। আল আকসার ওয়েস্টার্ণ ওয়াল ইহুদিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই দেয়ালটিকে ইহুদীরা পৃথিবীর ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে মনে প্রানে বিশ্বাস করে। এই দেয়ালটি “প্লেস অফ উইপিং” বা “কান্নার জায়গা” নামে পরিচিত যেটি চুনা পাথর দিয়ে তৈরি। ইহুদিদের কাছে আল আকসা “টেম্পল মাউন্ট” হিসেবে পরিচিত। ইহুদিদের বিশ্বাস টেম্পল মাউন্টেই আব্রাহাম তার পুত্র ইব্রাহিমকে উৎসর্গ করেছিলেন।
অবশ্যই পড়ুন
তাছাড়া ডোম অফ দা রক এর ভেতরে একটি পাথর রয়েছে যেটিকে ইহুদিরা ফাউন্ডেশন স্টোন হিসেবে অভিহিত করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে এই পাথরটি থেকে পৃথিবীর সূচনা হয়েছিল। অন্যদিকে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস আল আকসার এই জায়গাটিতে তাদের যীশুখ্রীষ্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং এখানে একটি গুহা রয়েছে যেখানে যীশু খ্রীষ্টের দেহ রাখা হয়েছিল।
আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্ব
প্রথমত, আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্ব এর কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে আসবে কিবলা পরিবর্তনের ইতিহাস। কিবলা পরিবর্তন বলতে নামাজ আদায়ের দিকনির্দেশক দিককে বোঝানো হয়। যেমন আমরা বাংলাদেশের মুসলিমরা পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়ি কারণ বাংলাদেশের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পবিত্র কাবা শরীফ।
আল আকসা মসজিদ নির্মাণের ৪০ বছর পূর্বে কাবা শরীফ নির্মাণ হওয়ায় প্রথমে কিবলা ছিল পবিত্র কাবা শরীফ। তবে মসজিদুল আকসা নির্মাণের পর এটি কিবলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে দ্বিতীয় কিবলা হল কাবা শরীফ। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের পর থেকে কাবা শরীফের দিকে মুখ করে মুসলিগণ নামাজ পড়তে থাকেন।
দ্বিতীয়তঃ পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে জেরুজালেমের কথা উল্লেখ আছে এবং অনেক হাদীসেও জেরুজালেমের উল্লেখ পাওয়া যায়। জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ইসলামের ইতিহাসের তৃতীয় সম্মানিত মসজিদ হিসেবে অধিষ্ঠিত। মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীর পরে আল আকসা মসজিদের স্থান।
মসজিদুল আকসায় নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন একজন লোক একাকী ঘরে নামাজ পড়লে এক নেকি, জামাতের সাথে নামাজ পড়লে ২৭ গুন, মসজিদে নববীতে নামাজ পড়লে ১ হাজার গুণ, মসজিদে আকসায় নামাজ পড়লে ৫ শত গুণ এবং মসজিদুল হারামে বা কাবাঘরে নামাজ পড়লে ১ লাখ গুণ সওয়াব বা নেকি পাওয়া যায়।
আল আকসা মসজিদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
আল আকসা মসজিদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ইসলামী ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত এবং এর সাথে মিরাজের রাতের ইতিহাসও খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কারণ মিরাজের রাতে মহানবী সাঃ মক্কা থেকে জেরুজালেমে এসে আল আকসা মসজিদে অবস্থান করেন।
এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে গমন করার পূর্বে এখানকার সকল নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইমাম হিসেবে নামাজ আদায় করেছিলেন। তারপর মিরাজের উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং মিরাজে যাওয়ার পর মহানবী সাঃ জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন এবং মহান আল্লাহতালার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
শেষ কথা
ইসলামিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা আল আকসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণ হারায় ১৯৬৭ সালের সংঘটিত আরব ইসরাইলের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। এর আগে জর্ডানের শাসকদের হাতে আল আকসা মসজিদের দেখাশোনার দায়ভার ছিল।
তবে বর্তমানে আল আকসা কম্পাউন্ড ইসরাইলের অধীনে থাকার পরেও আল আকসা মসজিদ নিয়ন্ত্রিত হয় জর্ডান এবং ফিলিস্তিনের একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কম্পাউন্ডের ভিতরে কেবলমাত্র মুসল্লিরা প্রবেশ করতে পারে ইসরাইলি দখলদার সেনাবাহিনীর যথেষ্ট পরিমাণ তল্লাশির পরে।
যাইহোক আল আকসা মসজিদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিজের মতো করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম। লেখাটি পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করতে পারেন আর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন। নিয়মিত Mubin Pedia ভিজিট করার আমন্ত্রণ রইল।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url