কোরবানির দিনে যে ১০ টি কাজ অবশ্যই করবেন
ইদ উল আযহা বা কোরবানির ইদ মানেই যেন আমাদের কাছে শুধু পশু জবেহ করা এবং মাংস খাওয়া। আসলে বিষয়টি শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কোরবানি নিয়ে অনেক বিধি নিষেধ নিয়মকানুন রয়েছে। এগুলো আমরা অনেকেই মানি না বা জানি না। কোরবানির দিনে যে দশটি কাজ অবশ্যই করবেন সে বিষয় গুলো হাদিস কোরআনের আলোকে তবে সংক্ষেপে এবং নিজের মতো করে সহজ ভাষায় আপনাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।
ইসলামিক পোস্ট এর আজকের এই পর্বে আপনারা জানতে পারবেন কোরবানির দিনে শরিয়াহ মোতাবেক আল্লাহর দরবারে আমাদের কোরবানিকে কবুল করাতে হলে যে নিয়ম কানুন গুলো আমাদের মেনে চলা উচিত সেই সব বিষয়ে। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
চেষ্টা করুন নিজ হাতে কোরবানি দিতে
কোরবানির দিনে একটা বিষয়ে আমরা অনেকেই সমস্যায় পড়ে যাই সেটা হল নিজ হাতে কোরবানি দিতে পারি না। অনেকে বলেন আমি রক্ত দেখতে পারি না বা পশুর গলায় ছুরি চালানো অনেক কঠিন ইত্যাদি। তবে ইসলামী নিয়ম মতে সবচাইতে উত্তম কাজ হল একজন ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিজ হাতে একটি পশু লালন পালন করে নিজ হাতে সে পশুকে জবেহ করবেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ:) কে আল্লাহতালা যখন নির্দেশ দেন তার প্রিয় বস্তু অর্থাৎ তার পুত্র ইসমাইল (আ:) কে কুরবানী করার জন্য তখন কিন্তু তিনি নিজ হাতেই তার পুত্রকে কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তিনি কিন্তু কোন ইমাম বা অন্য কোন ব্যক্তির সাহায্য নেন নি।
সঠিক নিয়মে পশু জবেহ করুন
পশু কোরবানি করার আগে ওষুধ জবের করা সঠিক নিয়ম জানাটা জরুরী। গরু, ছাগল, উট, দুম্বা সহ যে কোন হালাল পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত। কোরবানির শুরুর আগে ওযু করে নেয়া অর্থাৎ পাকপবিত্র হওয়া উত্তম। আমরা হাদিস থেকে জানতে পারি পশু জবেহ করার আগে ছুরি ভালো করে ধারালো করে নিতে হবে যাতে করে পশু জবাই করা সহজ হয় এবং পশুর অতিরিক্ত কষ্ট না হয়।
এরপর পশুর পা গুলোকে ভাল করে বেঁধে নিতে হবে যেন গলায় ছুরি চালানোর সময় পা ছড়াছড়ি করতে না পারে। জবেহ করার পূর্বে পশুকে শোয়ানোর বিশেষ নিয়ম রয়েছে। পশুকে কেবলামুখী করে বাম পাঁজরের উপর শোয়াতে হবে অর্থাৎ মুখ থাকবে পশ্চিম দিক করে এবং মাথা থাকবে দক্ষিণ দিকে। পশুর গলায় ছুরি চালানোর সময় “বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার” বলে ছুরি চালাতে হবে।
জবেহ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে তিনটি জিনিস অবশ্যই যেন কেটে যায়- খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দুই পাশে থাকা দুটি রগ। অনেক সময় দেখা যায় পশু যাতে খুব দ্রুত মারা যায় সেজন্য অনেকে ছুরির ধারালো কোনা দিয়ে পশুর গলায় খোঁচাখুঁচি করতে থাকেন। এমনটি করা হলে পশু জবেহ করা অর্থাৎ কোরবানি করা হবে না, সেটা হয়ে যাবে “পশু হত্যা করা”।
এরপর পাচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে পশু নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। অনেকে আছেন জবেহ করার সাথে সাথে যারা মাংস বানান তারা পশুর পায়ের রগ এবং চামড়া ছিলতে শুরু করেন যেটা মোটেও উচিত নয়। পশু সম্পূর্ণরূপে মারা যাবার পরেই মাংস বানানোর কাজ শুরু করতে হবে।
নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে রক্ত ফেলুন
পশু কোরবানির জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করুন। সেখানে একটি গর্ত করুন এবং গর্তের আশেপাশে কোরবানি দিন যাতে করে পশু জবেহ করার পরে রক্ত সে গর্তেই পড়ে এবং পরবর্তীতে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া যায়।
লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে গর্ত করে পশুর নাড়িভুড়ি ফেলুন
অনেককে দেখা যায় পশুর উচ্ছিষ্ট অংশ কোন জঙ্গলে, ড্রেনে, পুকুরে অথবা নদীতে ফেলে দেয়। এটি একদমই অবিবেচকের মত কাজ কারণ সেগুলো পচে দুর্গন্ধ এবং জীবাণু ছড়াবে। লোকালয় থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে গর্ত করে কোরবানি করা পশুর উচ্ছিষ্ট অংশ অর্থাৎ শিং, নাড়িভুড়ি, পায়ের খুর ইত্যাদি ফেলতে হবে। এরপর অবশ্যই মাটি চাপা দিতে হবে না হলে কুকুর সেগুলো ঘাটাঘাটি করে পরিবেশ নষ্ট করবে।
পশু জবেহ করার স্থান পরিষ্কার রাখুন
পশু জবেহ করার পর মাংস বানানো হয়ে গেলে সেই স্থানটি পানি, ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখুন। কেউ যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে না চায় তবে তাকে অনুরোধ করে বোঝান পরিষ্কার করার জন্য। তাহলে আমাদের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত থাকবে।
ইসলামী শরিয়াহ মতে কোরবানির মাংস ভাগ বন্টন করুন
মাংস বানানো হয়ে গেলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মাংসের সঠিকভাবে বন্টন করা। ইসলামী শরিয়া মতে কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করতে হবে এক ভাগ নিজের জন্য রেখে দিতে হবে, একভাগ আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীদের জন্য এবং এক ভাগ গরিব মিসকিনদের জন্য বন্টন করতে হবে। অনেক ব্যক্তি এই ভাবে ভাগ না করে সম্পূর্ণটা নিজের জন্য রেখে দেন অথবা কিছুটা অংশ আত্মীয়-স্বজন বা ফকির মিসকিন কে দেন।
গরুর মাংস করার সময় প্রত্যেকে সমান ভাগে মাংস নিন
একটি গরু যখন পাঁচ অথবা সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া হয় তখন একটি অনিয়ম চোখে পড়ে সেটি হল কোন কোন ক্ষেত্রে মাংস সমান ভাগে ভাগ হয় না। এরকমও অনেক সময় দেখা যায় মাংস বানানোর সময় একজন হয়তো বলে বসলো আমি বুকের মাংস খুব পছন্দ করি, এটি বলেই সে আলাদাভাবে বুকের মাংস নিয়ে নিল।
সেটা কিন্তু তার ভাগের হিসাবের মধ্যে পড়লো না। আবার হয়তো কেউ পা খেতে পছন্দ করে সে তখন বাকিদেরকে বলল আমার ক্যালসিয়ামের অভাব আমি এ দুইটা পা নিব, সেটিও কিন্তু তার ভাগের মাংসের বাইরেই থেকে গেল। আবার অংশীদারদের মধ্যে কেউ হয়তো লোক লজ্জার খাতিরে কিছু বলে না কিন্তু মনে মনে তারা সবাই বিরক্ত হয়।
আসলে এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিবেকটাকে কাজে লাগানো উচিত। একজন যদি ভাগের বাইরে কিছু মাংস নেই তাহলে তো প্রত্যেকেরই অধিকার আছে ভাগের মাংসের বাইরে কিছু মাংস নেয়ার। কিন্তু প্রত্যেকে যদি এই কাজটা করে থাকে তাহলে ইসলামের শরীয়ত নিয়ম যেমন মানা হবে না ঠিক তেমনি মাংস ভাগের ক্ষেত্রে হ-জ-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হবে। ভাগের প্রত্যেক অংশীদার কে এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।
আরও পড়তে পারেন
অসহায় দরিদ্রদের মাংস দিন
আমাদের কোরবানি দেওয়া পশুর মাংসের উপর সবচেয়ে বেশি হক রয়েছে অসহায় দরিদ্র, ফকির, মিসকিনদের। ঈদের দিন শুধুমাত্র আমরাই হাড়ি ভর্তি করে মাংস রান্না করে নিজেদের উদরপূর্তি করলাম আর আশেপাশের ফকির মিসকিনরা না খেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে- ব্যাপারটা একদমই অমানবিকতার পরিচয় দেওয়া হবে। ইসলামে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গরিবদের কোরবানির মাংস দিতে, এছাড়াও অসহায় দরিদ্রদের খাবার খাওয়ানো অনেক সওয়াবের কাজ।
আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীদের খোঁজ নিন
আমাদের প্রত্যেকেরই এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশী থাকেন যারা হয়তো আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়, তারা হয়তো পশু কোরবানি দিতে পারেন না। আবার সেটি হয়তো কাউকে বলতেও পারেন না লজ্জার খাতিরে। আমরা জানি আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশী দের আর্থিক অবস্থা কেমন। তাই এই ধরনের আত্মীয়-স্বজনদের এবং প্রতিবেশীদের আমাদের খোঁজ নেওয়া উচিত এবং নিজে থেকেই তাদের বাসায় গিয়ে মাংস দিয়ে আসা উচিত।
টাকা দিয়ে পারিশ্রমিক দিন
যারা পশু কোরবানি থেকে শুরু করে মাংস বানানো পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজই অন্য মানুষকে দিয়ে করান তাদের ক্ষেত্রে সেই মানুষটাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে। এখানে অনেকেই যে ভুলটি করে থাকেন সেটি হল পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে কিছু মাংস দিয়ে দেন। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি অনুচিত কাজ।
সেই লোকটি যদি আপনার কোরবানির কাজে কোন রকম ভাবে সাহায্য না করতো তবুও আপনার মাংসের উপর একজন অসহায় দরিদ্র হিসেবে তার একটি হক রয়েছে অর্থাৎ আপনাকে কোন রকম ভাবে সাহায্য না করলেও সে কিন্তু আপনার কোরবানির মাংসের গরিব-দুঃখীদের অংশ থেকে মাংস পেত।
তাহলে তার হকের অংশ দিয়ে তার পারিশ্রমিক দেন কিভাবে? এটি কখনোই জায়েজ হবে না। তাই এই মানুষগুলোকে মাংস দেয়ার পাশাপাশি টাকা দিয়ে তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করুন।
শেষ কথা
মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য দুইটি দিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের দিন- ইদ উল ফিতর এবং ইদ উল আযহা। ইদ উল আযহা শুধু আনন্দের দিন নয় বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ইবাদতের দিনও বলা যায়। সুষ্ঠুভাবে কোরবানি করা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই দিনে যে করণীয় গুলো আছে সে ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। অসাবধানতাবশত আনন্দের সাথে আমরা যেন এই দিনটিকে ইবাদতের পরিবর্তে বিতর্কিত করে না ফেলি।
এতক্ষণ ধরে ধৈর্য নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি যে ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো এগুলো আমরা সকলেই শুধরে নিব। লেখায় কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো আর নতুন কিছু জানতে চাইলে কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url