কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকুন
কোরবানি মানে শুধু মাংস খাওয়া নয়, কোরবানি মানে শুধু আনন্দ করা নয়। মাংস খেতে এবং আনন্দ করতে গিয়ে আমরা যেন কোন ভুল কাজ করে না থাকি সেই বিষয়ে আমাদের সবচাইতে বেশি নজর দেওয়া উচিত যেটা আমরা করি না। আজকের আর্টিকেলে আমরা জানবো কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত এই বিষয়ে।
"ইসলামিক তথ্য" এর আজকের এই পর্বে কোরবানি নিয়ে বেশ কিছু ভুলের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছি যাতে করে আমরা সকলে সচেতন হতে পারি। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। তাহলে চলুন জেনে নেই কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে যা আমরা সচরাচর করে থাকি।
কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকুন
ইদ উল আযহা বা কোরবানিকে কেন্দ্র করে পশু কেনা, পশু লালন পালন করা, কোরবানি করা, মাংস খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের আনন্দের শেষ থাকে না। তবে জেনে হোক বা না জেনে হোক কোরবানি নিয়ে বেশ কিছু ভুল কাজ আমরা হর হামেশাই করে থাকি। কোরবানির সম্পর্কে ইসলামে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে এবং সামাজিকভাবেও কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো করা উচিত নয়।
এ দৃষ্টিকটু কাজগুলো করার পরে আমরা হয়তো খেয়ালও করি না যে এই কাজগুলো আসলেই করা উচিত নয়। আজকে আমাদের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করতে চলেছি কেন কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থেকে বিরত থাকা সম্পর্কে। তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে বিষয়গুলো জেনে নেই।
পশুর দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা করা
আমাদের সমাজে কোরবানির পশু কেনা নিয়ে প্রতিযোগিতা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। সমাজের বিত্তবানদের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা দেই। অমুক এত লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনলো আমাকে তার চাইতে বেশি দামে কিনতে হবে- এই প্রবণতা একদমই ভুল। মূলত এটি বিকৃত মস্তিষ্কের একটি কাজ। ইসলামিক জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ এমন হীন কাজ করে থাকে।
লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বেশি দাম দিয়ে পশু কেনা
সমাজে অনেক বিত্তশালী আছেন যারা কোরবানির অর্থ পর্যন্ত জানেন না। তারা শুধু জানে লোকের কাছে নিজের ক্ষমতা এবং অর্থ জাহির করতে। তারা কোরবানির পশু কিনেই মূলত দুটি কারণে- প্রথমত, অনেক টাকা দিয়ে অনেক দামী পশু কিনেছে এটা মানুষকে দেখানোর জন্য এবং দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার জন্য। লোক দেখানো কোন কিছুই আল্লাহ পছন্দ করেন না।
অনেক দাম দিয়ে কেনা হয়েছে এটা মানুষকে বলে বেড়ানো
অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে অনেক দাম দিয়ে কোরবানির পশু কিনেই ক্ষান্ত হয় না, অনেকে আবার কারণে-অকারণে সেই পশুর দাম অন্যকে জানানোর চেষ্টা করে। রাস্তাঘাটে কারো সাথে দেখা হলে অথবা ফোনে কারো সাথে কথা বললে আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে তাদের কেনা পশুর দাম জানাবে। এতে এক ধরনের অহংকার প্রকাশ পায় আর অহংকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।
কোরবানির ২/১ দিন আগে পশু কেনা
ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক আপনাকে সেই পশু কোরবানি দিতে হবে যে পশুর প্রতি আপনার মায়া জন্মাবে আর মায়া তখনই জন্মাবে যখন আপনি বেশ কিছুদিন যাবত সে পশুটাকে পুষে থাকবেন।আমরা অনেকেই আছি যারা শহরে বসবাস করি।
শহরে গরু ছাগল পালন করার মত জায়গা থাকে না। এছাড়া আমাদের ব্যস্ততার কারণে সময় থাকে না। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কোরবানির ঠিক এক বা দুইদিন আগে পশু কিনে থাকি যেটা মোটেও উচিত নয়। বছরে একবারই কোরবানির ঈদ হয়, তাই বছরে একবার কিছুদিন কষ্ট করা যেতেই পারে।
কোরবানির পশুকে নিজ বাড়িতে না রাখা
শুধু শহরে নয় গ্রামেও দেখা যায় এই উদ্ভট কাজটি। কষ্ট না করার প্রবণতা অথবা সময় না থাকা যে কারণেই হোক অনেকে আছেন যারা যার কাছ থেকে কোরবানির পশু কেনা হয় তার বাড়িতেই ঈদের দিন পর্যন্ত রেখে দেন। সেই পশুর খাওয়া-দাওয়া বাবদ টাকা পয়সা দিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু কোরবানি দাতার বাড়িতে পশু আনা হয় না। এতে কি আদৌ সঠিকভাবে কোরবানি করা হয়? আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোঝার তৌফিক দান করুন।
পশু কেনার পরে লাভ লস নিয়ে হিসাব করা
১০ জন ব্যক্তির উপর জরিপ করলে দেখা যাবে প্রায় ৯ জন ব্যক্তিই এই আচরণের সাথে জড়িত। এটি অত্যন্ত অবিবেচকের মত কাজ। আমাদের মনে রাখা উচিত আমরা যারা পশু কিনে কোরবানি দেই আমরা কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্যে পশু কিনি না।
কাজেই এখানে মাংসের তুলনায় পশুর দাম বেশি হল না কম হলো, লাভ হলো নাকি লস হল- এসব চিন্তা করা বা এসব বিষয়ে কথা বলা একদমই অবান্তর। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা কোরবানির দিয়ে থাকি তাই আমাদের নিয়ত সেরকমই হওয়া উচিত।
পশু কেনার সময় মাংসের পরিমাণ নিয়ে হিসাব করা
পশু কেনার সময় অত্যন্ত পরিচিত একটা বিষয় হলো পশুর মাংসের পরিমাণ আন্দাজ করা। পশুর হাটে পশু কিনতে গেলে সেখানে বেশ কিছু বিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিকে দেখা যায়, এদের মধ্যে অনেকেই পশু বিক্রেতা আবার অনেকেই হাটের দালাল। আবার পশু ক্রেতাও অত্যন্ত আগ্রহের সাথে জানতে চায় দামের সাথে তার পশুর মাংসের সামঞ্জস্য হলো কিনা!
কি একটা উদ্ভট প্রচলন কি সুন্দর ভাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত!! অথচ ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক একজন পশু ক্রেতার দেখা উচিত ছিল শুধুমাত্র পশুটি সুস্থ কিনা, পশুর দাঁত-শিং সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো।
কেনার পর পশুর পরিচর্যা করতে গিয়ে বিরক্ত হওয়া
প্রায় সপ্তাহখানেক আগে পশু কেনার পর পশুর পরিচর্যার জন্য যে ঝামেলাগুলো হয় তার জন্য অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। এমনটা মোটেও করা উচিত নয়। আসলে কোরবানির পশু অনেকটা মেহমানের মত। তাকে যত্ন করতে হয়। সব সময় আমাদের মনে রাখা উচিত আল্লাহর হুকুমে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমরা কোরবানি দিয়ে থাকি।
তাই কোরবানির পশুর প্রতিও আমাদের সদাচার করা উচিত। অবশ্য এর উল্টো চিত্র দেখা যায়, অনেকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে যত্ন করে থাকেন কোরবানির পশুকে।
কোরবানির মাংস ইসলামিক বিধান অনুযায়ী ভাগ বন্টন না করা
ইসলামের বিধান অনুযায়ী কোরবানির মাংস কে তিনটি ভাগে ভাগ করতে হবে। একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীদের জন্য এবং এক ভাগ গরিব ফকির মিসকিনদের জন্য। অনেকে আছেন কোরবানির পরে পশুর মাংস করা হয়ে গেলে সাথে সাথে বাসায় নিয়ে এসে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখেন নিজেদের জন্য। প্রতিবেশী এবং ফকির মিসকিন দের হক আদায় করেন না।
হারাম টাকা দিয়ে পশু কেনা
এ ব্যাপারটি আসলে সম্পূর্ণ নিজের বিবেকের উপর নির্ভর করে। আপনি আপনার বিবেককে জাগাতে না পারলে কখনো কেউ আপনার বিবেক জাগাতে পারবে না। অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা, ঘুষের টাকা, দুর্নীতি করে উপার্জন করা টাকা দিয়ে কোরবানি দিলে সেই কোরবানি আল্লাহর দরবারে কখনোই কবুল করা হয় না। এটা আমাদের সবারই জানা, তারপরেও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমরা সেই হারাম টাকা দিয়েই কোরবানি দিয়ে থাকি।
কোরবানির হুকুম আহকাম মেনে না চলা
যে ব্যক্তি পশু কোরবানি দেয় তার জন্য ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক কিছু হুকুম আহকাম রয়েছে। যেমন সেই ব্যক্তি জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে কোরবানির দিন পর্যন্ত চুল, হাতের নখ কাটতে পারবে না, কোরবানির দিন পশু কোরবানির আগ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি কিছু খেতে পারবে না। এই বিধি নিষেধগুলো অনেক ব্যক্তি মেনে চলেনা। ফলে তার কোরবানিও পরিশুদ্ধ হয় না।
নিয়ত না করে কোরবানি করা
অনেকে আছেন কোরবানি দেওয়ার কাজ দিয়ে দেয় কিন্তু সঠিক নিয়ত করে না। আপনাদের মনে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, কে নিয়ত করল কি করলো না সেটা আমি জানলাম কিভাবে? আসলে বোঝা যায়। একজন মুমিন ঈমানদার বান্দা এবং একজন চোর বাটপারকে দেখলে কিন্তু বোঝা যায় কে কি রকম। একইভাবে আচরণগত দিক থেকে বোঝা যায় কে সঠিকভাবে নিয়ত করে কোরবানি দিচ্ছে আর কে দিচ্ছে না।
অবশ্যই পড়ুন
অনেক মানুষ আছে যারা শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যেই কোরবানি দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ভীতি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই কোরবানি দেওয়া উচিত আমাদের। রোজ হাশরে বিচারের দিন মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিয়ত, তাকওয়া, আল্লাহ ভীতি এসবই দেখবেন। কোরবানির পশু কত বেশি দামে কিনেছিলাম, মাংস কম হয়েছে না বেশি হয়েছে এসব আল্লাহর কাছে মূল্যহীন।
নামাজ না পড়ে কোরবানি করা
আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ে না কিন্তু কোরবানির সময় পশু কেনার ক্ষেত্রে তারা এক ধাপ এগিয়ে থাকে। কিন্তু নামাজ না পড়লে আল্লাহর দরবারে সেই কোরবানি কবুল হয় না- এই কথাটি এদের মধ্যে বেশিরভাগই জানেনা আর অল্প কিছু সংখ্যক জানা সত্ত্বেও কোরবানি দেয়।
আবার একটা গরু পাঁচ অথবা সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া যায়। এখন সাত ভাগের মধ্যে হয়তো ছয় জন নামাজী ব্যক্তি কিন্তু একজন নামাজী ব্যক্তি নয়। সেই একজন বেনামাজি ব্যক্তির কারণে বাকি ছয়জনের কোরবানি কবুল করা হবে না। ইসলামে স্পষ্টভাবে এটা জানিয়ে দেয়া আছে।
মতামত
পশু জবাই করা এবং মাংস খাওয়া অর্থাৎ কোরবানি করা শুধুমাত্র আনন্দ উৎসবের ব্যাপারই নয় বরং এটি একটি মহান ইবাদত। মুসলমান হিসেবে আমরা সকলেই এটি জানি। একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত সেটি হল- সঠিক নিয়তে কুরবানী করা হলে সেই পশুই রোজ হাশরের দিন আমাদেরকে পুলসিরাত পার করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে পারে।
কাজেই শুধু মাংস খাওয়ার কথা মাথায় না রেখে পুলসিরাত এবং জাহান্নামের কথা মাথায় রেখে আমাদের সকলের কোরবানির কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। তো যাই হোক কোরবানি নিয়ে ১৩ টি ভুল কাজ করা থাকে বিরত থাকা উচিত এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো। আমরা যারা এ ধরনের কাজ করে থাকি আশা করি এগুলো শুধরে নেব।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামিক জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়ার তৌফিক দান করুন। এতক্ষণ ধৈর্য নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ভুল ত্রুটি হলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আর নতুন কোন বিষয় জানার আগ্রহ থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url