সার্ক (SAARC) - দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা- কি কেন কিভাবে
পড়াশোনার কাজে, সাধারণ জ্ঞান অর্জনের জন্য, ভর্তি পরীক্ষার জন্য, চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য।
“সাধারন জ্ঞান” এর আজকের পর্বের আয়োজন সার্ক বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। এই লেখায় আমরা সার্কের আদ্যপ্রান্ত জানার চেষ্টা করব। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
সার্ক
সার্ক হল দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। ইংরেজিতে South Asian Association for Regional Cooperation বা সংক্ষেপে SAARC (সার্ক)। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার একটি জোট সার্ক।
সার্ক এর উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠা
অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য ছিল ব্যাপক। এসব বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রত্যেকটি দেশের উন্নতির লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি তৎকালীন ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ এবং ভুটানের রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানান একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। অবশেষে ৮ ই ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক।
প্রতিষ্ঠা কালীন সময়ে সার্কের সদস্য রাষ্ট্র ছিল ৭ টি যথা - বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এবং ভুটান। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের সদস্যপদ লাভ করায় বর্তমানে সার্কের মোট সদস্য সংখ্যা ৮। সার্কের দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি এবং সদর দপ্তর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থিত।
সার্কের পর্যবেক্ষক রাষ্ট
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মায়ানমার, ইরান, মরিশাস, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্কের ৯টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলন
নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক বছর শীর্ষ সম্মেলন এবং দুই বছর অন্তর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এ যাবৎকাল পর্যন্ত এই নিয়ম অনুযায়ী সার্কের কোন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। যেমন সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ২৬-২৭ নভেম্বর। এটি ছিল সার্কের ১৮ তম এবং সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন। শীর্ষ সম্মেলনের ক্ষেত্রে মূলত ভারতের বিরোধীতার কারণেই ২০১৪ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সার্কের আর কোন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি।
শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের বিরোধীতা কেন
সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের আপত্তির মূল কারণ হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত। অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালেবান এর রাজনৈতিক অগ্রগতির পর থেকে পাকিস্তান জোরালো ভাবে চাইছে উনিশ তম শীর্ষ সম্মেলন করার। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে দ্বন্দ্ব থাকায় ভারত বরাবরই এই সিদ্ধান্তে ভেটো দিয়ে আসছে। এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতকে ভার্চুয়ালি শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ জানালে ভারত সেটা নাকচ করে।
সার্কের লক্ষ্য
আটটি উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। সেই সম্মেলনে এ ৮ টি উদ্দেশ্য গৃহীত হয়।
- সার্কভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের সমষ্টিগত সহায়তায় নিজেদের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা।
- রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
- দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত দেশ সমূহের জনগণের আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা।
- পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মনোভাব তৈরি, বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সমঝোতা, বিশ্বাস স্থাপন, অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া।
- বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের সঙ্গে সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রসার ঘটানো।
- দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশ সমূহের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক অগ্রগতির পাশাপাশি নিজ নিজ আত্মমর্যাদা ঠিক রেখে নিজ অবস্থান থেকে সকল দেশের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টিতে একে অন্যকে সহযোগিতা করা।
- বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতা করা।
- জনসাধারণের ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামের সাথে ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাজ করা।
সার্কের সফলতা
খুব সামান্য পরিমাণ হলেও সার্কের সফলতা রয়েছে কিছু। যেমন সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সন্ত্রাসবাদ পুরোপুরি দমন সম্ভব না হলেও প্রতিরোধে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে সার্ক।
সার্কের ব্যর্থতা
প্রথমেই বলা যায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দমন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ সার্ক যার ফলশ্রুতিতে ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব আজ অব্দি আছে এবং যেটির কারণে আজ পর্যন্ত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়াও ভারত এবং শ্রীলংকার মধ্যে জঙ্গিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করার একটা মনোভাব পরিলক্ষিত হয় যেটি সার্কের মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী। উন্নয়ন কাজে সার্কের কোন সিদ্ধান্তে সদস্য রাষ্ট্রগুলো একই সাথে একই মনোভাব পোষণ করতে পারেনা কারণ তাদের মধ্যে মত পার্থক্য বিদ্যমান। পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা করার লক্ষ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠা হলেও বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র একে অন্যকে সাহায্য করতে চায় না। এ সকল কর্মকাণ্ডই আসলে সার্কের সফলতাকে ব্যাহত করে।
সার্কের শীর্ষ সম্মেলন সমূহ
প্রায় আটত্রিশ বছর আগে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবছর একটি করে শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও ৩৮ বছরে মোট শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ১৮ টি।
সার্কের মহাসচিব বৃন্দ
সার্কের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মহাসচিবের পদ অলংকৃত করেছেন।
শেষ কথা
মহৎ উদ্দেশ্য এবং বৃহৎ স্বার্থ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগী সংগঠন সার্ক। তবে সার্কের সামগ্রিক কার্যকলাপ সন্তোষজনক নয়। সন্ত্রাস দমন, দারিদ্র দূরীকরণের মত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইস্যুতে সার্ক সফলতা অর্জন করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার উপস্থিতি।
এতক্ষন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক সম্বন্ধে জানলেন। যাই হোক আমরা আশাবাদ ব্যক্ত করছি সার্কভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় একে অন্যকে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে হবে। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করবেন আর আরো নতুন কিছু জানার থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url