হিট স্ট্রোকের (Heat Stroke) কারন ও লক্ষণ - প্রতিরোধে করণীয়

গ্রীষ্মকালের তীব্র তাপদাহে অনেক সময় দেখা যায় অনেক ব্যক্তি মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়। আমরা অনেকেই জানিনা এটি আসলে হিট স্ট্রোক। হিট স্ট্রোকের কারণ এবং লক্ষণ না জানার কারণে আমরা তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নিতে পারি না।
হিট স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ - প্রতিরোধে করণীয়

আজকে আপনাদের হিট স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ এর পাশাপাশি প্রতিরোধে কি কি করণীয় আছে আমাদের সেই বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করব। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

হিট স্ট্রোক

মহান আল্লাহ পাক খুব সুন্দর ভাবে আমাদের শরীর সৃষ্টি করেছেন। আমাদের শরীরে উনি এমন একটা সিস্টেম করে দিয়েছেন যেটাতে বাইরের এবং ভেতরে তাপমাত্রার একটা সামঞ্জস্য বজায় থাকে। তবে বাইরের তাপমাত্রা অতিমাত্রায় বাড়তে শুরু করলে শরীর ভেতরে তাপমাত্রা বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। 
একসময় শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা বজায় রাখার সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং শরীরের ঘাম নির্গত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীরের ভেতরেও তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ভেতরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং বাইরের অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে যে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয় একজন মানুষের শরীরে সেটাকে বলা হয় হিট স্ট্রোক। 

সহজ কথায় বলা যায়, বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শরীরের যে অসুস্থতা দেখা যায় সেটিকে বলা হয় হিট স্ট্রোক। শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলেই হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হিট স্ট্রোকের কারণ

হিট স্ট্রোক সাধারণত প্রধান দুই কারণে হয়ে থাকে।
প্রথমত, তাপ প্রবাহ বা তাপের কারণে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় হিট স্ট্রোক হয়।
দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত তাপমাত্রার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করলেও হিট স্ট্রোক হয়ে থাকে।
কারো কারো ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোক খুব ধীরে ধীরে শুরু হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যায়।

তাপ প্রবাহ বা তাপ দাহ

বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা পরপর চার থেকে পাঁচ দিন সর্বোচ্চ অবস্থায় বিরাজ করার ফলে অস্বস্তিকর অস্বাভাবিক এবং মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্র আবহাওয়ার অবস্থানই হলো তাপ প্রবাহ বা তাপ দাহ।
হিট স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ - প্রতিরোধে করণীয়

তাপ দাহের প্রকারভেদ

তাপ দাহ বা তাপ প্রবাহ মূলত চার ধরনের।
মৃদু তাপ প্রবাহ: 
বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা যদি ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে তবে সেটিকে বলা হয় বিদ্যুৎ তাপ দাহ।
মাঝারি তাপ প্রবাহ: 
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যদি ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে তবে সেটি হল মাঝারি তাপপ্রবাহ।
তীব্র তাপ প্রবাহ: 
৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে যদি বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা থাকে তবে সেটি তীব্র তাপদাহ।
অতি তীব্র তাপ প্রবাহ: 
৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর উপরে তাপমাত্রা বিরাজ করলে সেটিকে বলা হয় অতি তীব্র তাপ প্রবাহ। রাজশাহীতে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।
সাধারণত তীব্র তাপ প্রবাহ এবং অতি তীব্র তাপ প্রবাহে হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

যাদের হিট স্ট্রোক করার সম্ভাবনা বেশি থাকে

যে কারো যেকোনো সময় হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে যার কারণে শিশু এবং বৃদ্ধদের হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ শিশুদের এবং বৃদ্ধদের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে ফলে সহজেই শরীর দুর্বল হয়ে যায়। আবার বৃদ্ধ এবং শিশু উভয়ে পানি কম খাওয়ায় এদের শরীরে পানি স্বল্পতার কারণেও হিট স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 
তাছাড়া ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, হার্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এরকম রোগীদের হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে দিনমজুর এবং প্রচন্ড রোদে যারা কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জন করে যেমন কৃষক, রিক্সাওয়ালা ইত্যাদি।

হিট স্ট্রোকের লক্ষণ

হিট স্ট্রোকের লক্ষণ জানাটা অত্যন্ত জরুরী। লক্ষণ গুলো জানা থাকলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত একজন ব্যক্তিকে সহজে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচানো সম্ভব। চলুন, জেনে নেওয়া যাক হিট স্ট্রোকের লক্ষণ।
  • শরীরে ঘামের পরিমাণ কমতে কমতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়।
  • শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকবে।
  • ত্বক অত্যন্ত শুষ্ক ও গরম হয়ে যায় এবং ত্বকে হাত দিলে মনে হবে জ্বর আছে শরীরে।
  • মুখ জিব্বা শুকিয়ে যাওয়া অর্থাৎ শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দেয়।
  • কখনো কখনো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব হয়।
  • হার্টবিট অত্যন্ত বেড়ে যায়। বুকের বাম পাশে হাত দিলে বা হাতের কব্জিতে নাড়িতে স্পর্শ করলে বোঝা যাবে খুব দ্রুত রক্ত চলাচল হচ্ছে।
  • শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মনে হবে যে, উনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না।
  • বমি বমি ভাব হয়, অনেক সময় বমি হয়েও যায়।
  • প্রচন্ড মাথা ব্যথার পাশাপাশি মাথা ঘুরতেও পারে।
  • শরীরে খিচুনি হতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলতে গেলে তার কথা জড়িয়ে যায়।
  • কখনো কখনো অকারণে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারে অথবা অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারেন।
  • সবশেষে রোগী অচেতন হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

হিট স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা

কোন ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাকে হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। তবে সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেয়ার পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে করতে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা বাড়িতেই গ্রহণ করা যেতে পারে যাতে করে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনাটা বৃদ্ধি পায়। যেমন-
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব ঠান্ডা স্থানে অথবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে নিয়ে আসতে হবে।
  • শীততপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ব্যবস্থা না হলে ছায়া নিচে বা ঘরের ভেতরে টেবিল বা স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে দিতে হবে। সিলিং ফ্যানের চেয়ে স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাস কিছুটা ঠান্ডা হয়।
  • ফ্যানের ব্যবস্থাও করা না গেলে পাখা দিয়ে দ্রুত বাতাস করতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে অতিরিক্ত পোশাক খুলে দিতে হবে।
  • ভেজা কাপড় দিয়ে পুরো শরীর মুছে ফেলতে হবে।
  • শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য ঘাড়ের নিচে, বগলে, পেটে, পিঠে ভেজা কাপড় দিয়ে রাখতে হবে।

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়

প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করার মুখ্য উপায় হল তাপমাত্রার থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তাই হিট স্ট্রোক প্রতিরোধের অর্থাৎ তাপ প্রবাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করার বেশ কিছু পদক্ষেপ আছে যেগুলো নিলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি। তবে এই পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করলে নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না যে হিট স্ট্রোকে কেউ আক্রান্ত হবে না, কিন্তু সম্ভাবনাটা অনেকটাই কম থাকবে। চলুন জেনে নেয়া যাক শীত স্ট্রোক প্রতিরোধে করনীয় কি আছে।
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে সারা দিনে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। পানি পানের পাশাপাশি যে কোন তরল খাবার যেমন ফলের রস, জুস, স্যালাইন ইত্যাদিও খেতে হবে।
  • বাসার কিংবা বাইরের ভাজাপোড়া, স্ট্রিট ফুড পরিহার করতে হবে।
  • খাবার সহজে হজম হয়, শরীর ভালো থাকে, পেট ঠান্ডা রাখে এরকম খাবার খেতে হবে। বেশি বেশি ফল এবং সবজি খাওয়া যেতে পারে।
  • বাইরে রোদে বের হতে হলে অবশ্যই ছাতা বা টুপি ব্যবহার করতে হবে।
  • বাসার ভেতরে অথবা বাইরে সর্বদাই সাদা রংয়ের অথবা একদম হালকা রঙের পোশাক পরিধান করতে হবে।
  • তীব্র গরমে তাপ থেকে বাঁচার জন্য সব সময় সুতি এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে।
  • প্রচন্ড তাপে শরীরের পানি শূন্যতা দূর করতে বাসার বাইরে গেলেই অবশ্যই সাথে পানির বোতল রাখুন।
  • প্রচন্ড গরমে চা, কফি, অ্যালকোহল, মদ ইত্যাদি পান করা থেকে বিরত থাকুন। এতে শরীরে তাপমাত্রা খুব বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়।
  • বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি অথবা দূরে কোথাও ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন।
  • বাইরে কোন কাজ করতে হলে চেষ্টা করবেন সে কাজটি রোদে না করে ছায়াতে করার।
  • ভুলেও কাল বা যেকোনো গাড়ো রঙের পোশাক পরবেন না। এগুলো অতিমাত্রায় তাপ শোষণ করে।
  • যথাসম্ভব ভিড়, কোলাহল এড়িয়ে চলুন।
  • অতিরিক্ত গরমে বাইরের খাবার যেমন কাচ্চি বিরানী বা যে কোন রেস্টুরেন্ট এর খাবার এড়িয়ে চলুন।
হিট স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ - প্রতিরোধে করণীয়

শেষ কথা

গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড তাপদাহের সময় হিট স্ট্রোক একটি ঝুঁকির নাম। আমরা একটু সচেতন হলেই নিজেরা যেমন হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে পারি ঠিক তেমনি আমাদের আশেপাশের লোকজন কেউ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারি।
হিট স্ট্রোক সম্পর্কিত বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করলাম আপনাদের। আশা করি আপনারা অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করবেন আর এরকম আরো তথ্য জানার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url