হজ সম্পর্কিত কিছু অনিয়ম যা আমাদের সমাজে প্রচলিত

মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত গুলোর মধ্যে একটি হল হজ। কিন্তু এ হজ সম্পর্কিত কিছু অনিয়ম রয়েছে মূলত ইসলামিক জ্ঞানের অভাবে অর্থাৎ হাদিস কোরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই আমাদের সমাজে এসব অনিয়ম প্রচলিত।
হজ সম্পর্কিত কিছু অনিয়ম যা আমাদের সমাজে প্রচলিত

"ইসলামিক তথ্য" এর আজকের এ পর্বে হজ সম্পর্কিত এই অনিয়ম এবং বিদআত গুলো সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করব যাতে আমরা সাবধান এবং সচেতন হতে পারি।

হজ সম্পর্কিত কিছু অনিয়ম যা আমাদের সমাজে প্রচলিত

মুসলিমদের জন্য হজ অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত যা আল্লাহর কাছেও এই ইবাদতের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ করতে গিয়ে আমরা অজ্ঞতার কারণে এমন কিছু কাজ করে ফেলি যেগুলোতে আমাদের হজ বিতর্কিত হয়ে যায়। 

হজ সম্পর্কিত এমনই কিছু অনিয়ম বা বিতর্কিত কাজ যা আমাদের সমাজে প্রচলিত অর্থাৎ আমাদের দ্বারাই সে কাজগুলো হয়ে থাকে সেসব বিষয় নিয়েই মূলত আজকের এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে। তো চলুন কথা না বাড়িয়ে বিষয়গুলো জেনে নেই। 

দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো

হজ সম্পর্কিত যে অনিয়ম গুলো রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হলো, হজে যাওয়ার পূর্বে হজ প্রার্থীগণ আত্মীয়-স্বজন এবং আশেপাশের প্রতিবেশীদের দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে থাকেন। হাদিস অনুযায়ী কাউকে খাবার খাওয়ানো অথবা পানি পান করানো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। তবে এটি হতে হবে কোন উদ্দেশ্য বা  স্বার্থ ছাড়া।  

যেমন জন্মদিনের দাওয়াত, চাকরিতে পদোন্নতির দাওয়াত, বিবাহ বার্ষিকীর দাওয়াত, হজে যাওয়ার পূর্বে লোকজনকে জানানোর জন্য দাওয়াত এগুলো ইসলাম শরীয়ত মোতাবেক খাওয়ানো যাবে না অর্থাৎ এটি স্পষ্টত বিদআত। তবে বিয়ের দাওয়াতটা ইসলাম সম্মত কিন্তু সেটিও যতটা কম আয়োজনের মধ্যে সম্পন্ন করা যায় ততটাই উত্তম। 

ইসলামী হুকুম আহকাম এর বিরুদ্ধে অর্থাৎ হাদিস-কোরানে যা নেই তা যদি আমরা করে থাকি সেটি হল বিদআত। হাদিস কোরআনের কোথাও উল্লেখ নেই যে হজে যাওয়ার পূর্বে হজকে উদ্দেশ্য করে মানুষকে খাওয়াতে হবে। এখন মানুষ অনেক ব্যস্ত, আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত মানুষ এখন সময়ের অভাবে করতে পারে না। 

মোবাইল ফোনে কথা বলে যোগাযোগের কাজ সম্পাদন করে সেখানে দাওয়াত দেওয়া বা দাওয়াত নেওয়া অনেক দূরের কথা। কিন্তু সমাজে এরকম অনেক মানুষ রয়েছে যারা সাধারণত কোন গরিব অসহায় দুস্থদের কখনোই খাওয়ায় না কিন্তু হজে যাওয়ার পূর্বে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায় লোক জানানোর উদ্দেশ্যে।

পোশাক দেওয়া

হজের দাওয়াত পেয়ে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী দাওয়াত খেতে আসলেন, ভুরিভোজ করলেন, তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অনেকেই হয়তো আবার হজ প্রার্থীকে বিভিন্ন পোশাক যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি গিফট করলেন। অনেক হট প্রার্থী আছেন যারা আসলে কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে দাওয়াত দেন না তারা বিব্রত বোধ করেন আবার কিছু কিছু হসপ্রার্থী আছেন যারা এ ধরনের পোশাক না দিলে খুশি হন। দুই পক্ষই এ ব্যাপারটাকে একটি উৎসব আমেজের দিকে নিয়ে যায়।

টাকা পয়সা দেওয়া

আবার অনেকেই আছেন জামা কাপড় না দিয়ে সরাসরি টাকা দেন। গিফট দাতা হয়তো বলে বসেন যে, এই টাকা দিয়ে যেন তিনি কিছু কিনে নেন সেটা জামা কাপড় হতে পারে, খাবার দাবার বা অন্য যে কোন কিছু হতে পারে। উপরের পয়েন্ট অর্থাৎ পোশাক দেয়া অথবা টাকা-পয়সা দেয়া মূলত একই ধরনের কাজ। 

এ কাজগুলো দেখে কি কিছুর সাথে মিল পাচ্ছেন? সাধারণত কোন দাওয়াত পেলে আমরা কি করি? অবশ্যই সে দাওয়াতে যাওয়ার পূর্বে দাওয়াতের জন্য কিছু গিফট কিনি অথবা নগদ কিছু অর্থ প্রদান করি। এভাবে হজের দাওয়াতেও কিন্তু সেই কাজগুলো করা হয়। বিয়ের দাওয়াত এর কথাই ধরি। 
বিয়ের দাওয়াত একটি আনন্দের দাওয়াত সেখানে আমরা আনন্দের সাথে খেতে যাই এবং গিফট প্রদান করি কিন্তু হজের জন্য দাওয়াতটা কি আনন্দের বা উৎসবের কোন দাওয়াত? কখন কোথায় কি করা উচিত সেটা আমাদের বিবেক দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

সৌদি আরবে কেনাকাটার পরিকল্পনা করা

দাওয়াতের কেচ্ছা কাহিনী তো গেল। এবার আসুন হজ প্রার্থীদের ভেতরে কিছু উদ্ভট চিন্তাভাবনা নিয়ে জানি। অনেক হজ প্রার্থী আছেন যারা হজে যাওয়ার পূর্বে অত্যন্ত উত্তেজিত বা এক্সাইটেড হয়ে থাকেন যে তারা সৌদি আরবে গিয়ে কি কি কেনাকাটা করবেন। তাদের কথাবার্তা এবং আচরণে বোঝা যায় সৌদি আরবে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো কেনাকাটা করা, হজব্রত পালন করা নয়। 

এর জন্য সঙ্গে তারা মোটা অংকের টাকা পয়সা নিয়ে যান সৌদি আরবে সোনার গহনা, ঘড়ি, বিভিন্ন ধরনের পোশাক, কসমেটিক্স ইত্যাদি এগুলো কিনার জন্য। অথচ একজন প্রকৃত হজ প্রার্থীর মনোবাসনা হওয়া উচিত ছিল তিনি সৌদি আরবে গিয়ে কি কি ইবাদত বন্দেগি করলে আল্লাহ সম্পূর্ণরূপ সন্তুষ্ট হবেন এবং নিজের পাপ মোচন করে দেশে ফিরে আসতে পারবেন।

নিয়মিত আমল না করা

একজন ব্যক্তি যখন সিদ্ধান্ত নিবেন যে তিনি হজ করতে যাবেন অবশ্যই তার কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা সবকিছুর ভেতরেই বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, সংযত হতে হবে। সাধারণত মুমিন মুসল্লীরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই নামাজ শেষে বিভিন্ন দোয়া দরুদ পড়ে থাকেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করে থাকেন। 

অথচ এমন কিছু ব্যক্তিকে দেখা যাবে যিনি হজ করতে যাবেন অথচ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে শুধুমাত্র ফরজ নামাজ ছাড়া আর কিছুই আমল করেন না, সুন্নাত, নফল নামাজ নাই, দোয়া কালাম নাই। এমনকি তার কথাবার্তা, চালচলনেও সংযমের ছিটেফোটাও থাকে না। 

বন্ধুবান্ধবদের সাথে আগে যেমনটা অশালীনভাবে কথা বলতেন, হজে যাওয়ার আগে মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সেভাবেই তার কথাবার্তা চালিয়ে যান। আসলে এই ধরনের ব্যক্তিরা হজের গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের এক ফোটাও কিছু বোঝেনা, টাকা আছে তাই হজ করতে যায়।

হজ পালনকারী ব্যক্তির সাথে আগের দিন দেখা করা

হজ সম্পর্কিত বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে এটি মারাত্মক একটি অনিয়ম। হয়তো মনে আপনাদের প্রশ্ন আসছে, দেখা করতে আসা আবার কেন অনিয়ম হলো? মানছি হজ প্রার্থীদের সাথে আত্মীয়-স্বজনের দেখা করতে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অনেক আবেগেরও বটে। হজ করতে যাচ্ছেন তিনি আবার ফিরে আসবেন কি আসবেন না, তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নেওয়া বা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ইত্যাদি অনেক বিষয় থাকে। 

তবে এটাও আত্মীয়-স্বজনদের অবশ্যই খেয়াল করা উচিত যে সম্পূর্ণ একটি নতুন জায়গায় হজ প্রার্থীগন যাচ্ছেন, তাদের সাথে টুকিটাকি অসংখ্য জিনিস সাথে নিতে হবে। তো এইসব জিনিস গোছানোর একটা ব্যাপার থাকে তার সাথে মানসিক এবং শারীরিক প্রস্তুতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে। 
এখন হজে যাওয়ার আগের দিন রাত পর্যন্ত যদি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী দেখা করতে যায় তবে এসব প্রস্তুতির হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলতে বলতেই দেখা যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিতে ভুলে যান এবং এর খেসারত দিতে হয় হজ করতে যেয়ে, ওখানে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস উনারা হয়তো পান না।

হজ পালনকারী ব্যক্তিকে কিছু আনতে বলা

অনেক আত্মীয়-স্বজন আছেন যারা হজ প্রার্থীকে কিছু টাকা দিয়ে গয়না, জামা কাপড় অথবা খেজুর নিয়ে আসতে বলেন। অনেক সময় হজ প্রার্থীর জন্য এই ব্যাপারটি অনেক বিব্রতকর হয়ে যায়। তিনি টাকা নিতেও পারেন না আবার মুখের উপরে ‘না’ বলতেও পারেন না। কারণ তিনি ইবাদত বন্দেগী করতে যাচ্ছেন, শপিং করতে যাচ্ছেন না। 

এ ধরনের নির্বোধের মত কাজ করা থেকে আমাদের সকলেরই বিরত থাকা উচিত। এমনিতেই হজ শেষে হাজিগণ জমজমের পানি এবং খেজুর অবশ্যই নিয়ে আসেন এবং সেটা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের বিতরণ করেন। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বরকতময় জিনিস।

হজ প্রার্থীকে দেখে কান্না কাটি করা

আমাদের সমাজে প্রচলিত হজ সম্পর্কিত আরেকটি বিশেষ অনিয়ম হলো, হজ প্রার্থীর সাথে দেখা করতে এসে আত্মীয়-স্বজনদের হজ প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা। হজ প্রার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই ভেবে যে তিনি হয়তো হজ পালন করে আর দেশে ফিরে আসতে পারবেন না। 


আরও পড়তে পারেন

একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, একজন হজ প্রার্থী তার ফ্যামিলিকে ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশে, ভিন্ন এক পরিবেশে একাই বা পরিচিত দু একজনের সাথে হজ পালন করতে যান। এদিক থেকে উনি এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে থাকেন। আর তারপরে এইভাবে অন্তত ১০ জন আত্মীয়-স্বজনের সাথে ১০ বার যদি কান্নাকাটি করে থাকেন তবে তার মানসিক অবস্থাটা কোন পর্যায়ে যেতে পারে! আমাদের সকলেরই সেটি চিন্তা করা উচিত।

বৃদ্ধ বয়সে হজে যাওয়া

বৃদ্ধ বয়সে হজে না গিয়ে অল্প বয়সে বা যুবক অবস্থায় হজে যাওয়া উচিত। আমার এই কথাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন সংসার খরচ যোগাতে যোগাতে সারাটা জীবন পার করে দেন। শেষ জীবনে গিয়ে হয়তো পেনশনের টাকা দিয়ে উনারা হজ পালন করতে পারেন। 

তবে যাদের যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উনারা গাড়ি-বাড়ি করা, বিদেশে গিয়ে শপিং করা এসব কাজেই উনারা টাকা অপচয় করেন এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে হয়তো তাদের উপলব্ধি হয় যে তারা জীবনে অনেক গুনাহ করেছেন এখন হজ করাটা জরুরী। উনারা তখন হজ করতে যান যখন উনাদের শরীরে আর তেমন শক্তি থাকে না। 

হজে গিয়ে ইসলামের অনেক হুকুম আহকাম রয়েছে যেগুলো পালন করতে যথেষ্ট পরিমাণ শারীরিক শক্তি প্রয়োজন হয় যেমন সাফা মারওয়ায় সাই করা, প্রত্যেক দিন প্রত্যেক রাকাতে বাসা থেকে প্রায় দুই তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে নামাজ আদায় করা, প্রত্যেকদিন কাবা শরীফ তাওয়াফ করা- এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে শারীরিক শক্তি না থাকলে এ কাজগুলো করা অনেক কষ্টকর। তাই অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হজ পালন করা উচিত।

ব্যক্তিগত মন্তব্য
উপরে হজ সম্পর্কিত কিছু অনিয়ম যা আমাদের সমাজে প্রচলিত সেই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো। আসলে জেনে হোক বা না জেনে হোক প্রত্যেকটা অনিয়মের সাথে কমবেশি আমরা সকলেই জড়িত। হজ কে ঘিরে এ অনিয়মগুলো বোঝার তৌফিক দান করুন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন। আমরা হাদিস এবং কোরআন পড়বো, বুঝবো, জানবো এবং সে অনুযায়ী আমাদের জীবন পরিচালনা করব। আমাদের মনে রাখতে হবে হজ কোন উৎসব নয়, এটি প্রত্যেকটা মুসলিমের জন্য একটি মহান ইবাদত।
এতক্ষণ ধরে ধৈর্য সহকারে লেখাটি পড়ার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। লেখায় কোনো ভুল ভ্রান্তি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে সবার সাথে শেয়ার করতে পারেন এবং আরো কিছু অনিয়ম যদি থেকে থাকে যেটি এখানে উল্লেখ করা হয়নি সেটি কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url