তীব্র তাপদাহে (Heat Wave) কি করবেন আর কি করবেন না
এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে বলা হচ্ছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হলেও ঘরে চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই, আমাদের কাজ করতে বাইরে যেতেই হয়। তবে আমরা অনেক সময় অসাবধানতা বা অসচেতনতার কারণে বাইরে গিয়ে প্রচন্ড তাপে, রোদে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আজকের জেনে নিতে পারেন তীব্র তাপদাহে কি করবেন আর কি করবেন না।
আজকের এই লেখায় আমরা আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব প্রচন্ড গরমের সময় নিজেকে সুস্থ রেখে কোন কাজগুলো করা উচিত এবং কোন কাজগুলো করা উচিত নয়। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
তীব্র তাপদাহ
বায়ুমন্ডলে বায়ুর অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে একটানা ৪ থেকে ৫ দিন বা তারও বেশি তাপমাত্রার পাশাপাশি আদ্রতা যদি বাড়তেই থাকে তবে সে অবস্থাকে তাপ প্রবাহ বা তাপদাহ বলা হয়। ইংরেজিতে এটিকে বলা হয় হিট ওয়েভ (Heat Wave)।
তীব্র তাপ দাহের প্রভাব
- যেকোনো বয়সের মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বিশেষ করে ছোট বাচ্চা এবং বৃদ্ধরা ঝুঁকিতে থাকে।
- ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয় কারণ সেচের অসুবিধা হয়ে যায়
- বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।
- দাবানলের শঙ্কা বেড়ে যায়।
- তাপ দাহের প্রভাবে হিট স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
- গবাদি পশুরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
প্রচন্ড গরমে যে কাজগুলো করবেন
চলুন জেনে নেই প্রচন্ড গরমে কোন কাজগুলো করলে আমরা নিজের সুস্থ থেকে আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারব।
প্রচুর পানি পান করুন
গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে তাপদাহের সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডিহাইড্রেসন হওয়া অর্থাৎ শরীরের পানি শূন্যতা সৃষ্টি হওয়া। শরীরের প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। তাই এই ডিহাইড্রেশন যাতে না হয় এজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে এমনকি পিপাসা না পেলেও পানি পান করা উচিত।
তরল খাবার বেশি খান
তাপদাহের সময় বেশি পরিমাণে তরল খাবার খাওয়া যেতে পারে। তরল খাবারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ফলের রস, জুস, শরবত ইত্যাদি। গ্রীষ্মকালে অনেক ফল পাওয়া যায় যেমন তরমুজ, বাঙ্গি। এই ফলগুলোকে ব্লেন্ডারে জুস করে খেতে পারেন এতে পেট ঠান্ডা থাকে। এছাড়াও গুড় অথবা চিনির সাথে লেবু মিশিয়ে তাতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে খেলে শরীরটা যেমন সতেজ হয় তেমনি শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ হয়। এছাড়াও স্যালাইন হতে পারে তাপ প্রবাহ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটি কার্যকরী হাতিয়ার।
ভাজাপোড়া পরিহার করুন
আমরা বাঙালিরা ভাজাপোড়া খেতে খুবই পছন্দ করি। রাস্তার ধারে কিংবা কোন রেস্টুরেন্টে ভাজাপোড়া দেখলে আমাদের জিভে জল আসবেই। তবে মনে রাখতে হবে এই খরার সময় অর্থাৎ প্রচন্ড তাপদাহের সময় ভাজাপোড়া খেলে কিন্তু আমাদের পেটের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে না। এতে বদহজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই যতটা সম্ভব ভাজাপোড়া, স্ট্রিট ফুড, জাঙ্ক ফুড এসব এড়িয়ে চলাই উত্তম।
ছাতা বা টুপি ব্যবহার করুন
শুধু বর্ষাকালেই নয় গ্রীষ্মকালেও ছাতার ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাপ প্রবাহের সময় সুস্থ থাকতে চাইলে বাসা থেকে বাইরে বের হলে অবশ্যই আপনাকে ছাতা অথবা টুপি ব্যবহার করতে হবে। মাথার উপর প্রচন্ড সূর্যের তাপ তারপর আবার আমাদের চুল কালো হওয়ায় তাপ শোষণ করে বেশি। ফলে আমাদের মস্তিষ্ক গরম হয়ে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা যেমন হিট স্ট্রোক হতে পারে, মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি।
খাবার গ্রহণে সচেতন হোন
গরম কালে সুস্থ থাকতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই খাবার গ্রহণে সচেতন হতে হবে অর্থাৎ কি খাবেন আর কি খাবেন না সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যেগুলো সহজে হজম হয়, পেট ঠান্ডা রাখে এই ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে যেমন লাউ, শসা পেটের জন্য খুবই ভালো। তরকারিতে ঝাল কম খাওয়া উচিত। মাছের মধ্যে তৈলাক্ত মাছ এবং মাংসের চর্বি গরমের দিনে খাওয়া উচিত নয়।
সাদা রঙের পোশাক পরুন
বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত কালো যে কোনো জিনিস সূর্যের আলো বা তাপ শোষণ করে খুব বেশি পরিমাণে। তাই রোদে বের হলে অবশ্যই সাদা রঙের পোশাক অথবা যে কোন হালকা কালারের পোশাক পরতে পারেন। এতে যেমন তাপ শোষণ কম হবে ফলে আপনার শরীর থাকবে ঠান্ডা তেমনি আরামও পাবেন।
সর্বদা সঙ্গে পানির বোতল রাখুন
বাসায় থাকলে একটু পর পর পানি খাওয়ার পাশাপাশি বাসা থেকে বের হলে অবশ্যই সঙ্গে করে পানির বোতল নিয়ে বের হতে হবে। কেননা বাইরে পিপাসা লাগলে অথবা রোদে পানি শূন্যতা দেখা দিলে পানি খেতে চাইলে অনেক সময় বাইরে শুদ্ধ পানি পাওয়া নাও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনার নিজের বাসার পরিশুদ্ধ পানি পান করা উত্তম।
সুতি কাপড় পড়ুন
তীব্র গরমে যদি আরাম পেতে চান তবে মোটা, সিন্থেটিক, নাইলন, পলেস্টার, টেট্রন বা অন্য যেকোনো কাপড় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র হালকা রঙের সুতি ঢিলেঢালা কাপড় পরিধান করুন। এতে করে আপনার পোশাকের ভেতরে বাতাস চলাচল করতে পারবে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাইরে তাপমাত্রার সাথে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখবে। তাছাড়া গরমের দিনে ঘেমে গেলেও সুতি কাপড়ের তৈরি পোশাকের চেয়ে অন্য কাপড়ের তৈরি পোশাক পরলে বেশি অস্বস্তি অনুভব হয়।
চা কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
গ্রীষ্মকালে এমনিতেই বাইরের তাপমাত্রা বেশি থাকে এরপর আপনি গরম চা বা কফি পান করলে শরীরের ভেতরেও আপনার তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। তাই তাপদাহের সময় চা বা কফি পান করা থেকে বিরত থাকুন। তবে যাদের একদমই চা-কফি ছাড়া চলে না তারা দিনে সর্বোচ্চ এক থেকে দুইবার চার বা কফি খেতে পারেন।
প্রচন্ড গরমে যে কাজগুলো করবেন না
এবার জেনে নেয়া যাক কোন কাজগুলো করলে আমরা অসুস্থ হয়ে যেতে পারি ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনায় ব্যাঘাত করতে পারে।
ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন
আপনি ভ্রমণ করতে যাবেন আপনার মানসিক শান্তি এবং আনন্দের কারণে। কিন্তু এই ভ্রমণ করতে যেয়ে যদি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে ভ্রমণটাই বৃথা হয়ে যায়। ভ্রমণে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে তো আর হয় না এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে হয়, হাঁটাচলা করতে হয় অবশ্যই সেটা রোদের মধ্যেই করতে হবে। এক দিকে ভ্রমণের জন্য অন্য জায়গায় যান তার উপরে মাথার উপর সূর্য, অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাটা তাই থাকে অনেক বেশি। সুতরাং তা প্রবাহের সময় সকল ধরনের ভ্রমণ থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
রোদে কাজ করবেন না
পারোত পক্ষে চেষ্টা করবেন গ্রীষ্মকালে রোদে কোন কাজ না করতে। তবে আপনার কাজের ধরন যদি হয়ে থাকে খোলা মাঠে বা আকাশের নিচে যেমন কৃষিকাজ তাহলে চেষ্টা করবেন একটু পর পর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে। আবার আপনি যদি খেলোয়াড় হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই খেলার আগে পর্যাপ্ত পানি পান করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাঠে নামবেন খেলতে।
কালো পোশাক পরবেন না
আগেই বলা হয়েছে গ্রীষ্মকালে কালো রং তাপ শোষণ করে খুব বেশি। তাই অতিরিক্ত গরমের সময় কাল, গাঢ় খয়রি, বেগুনি, নেভি ব্লু, লাল এসব রংয়ের পোশাক পরিহার করুন।
রিচ ফুড পরিহার করুন
যারা ভোজন রসিক আছেন অর্থাৎ যারা খেতে খুব ভালোবাসেন অথবা যাদের বাইরে যখন তখন হুটহাট করে বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাস আছে এবং যাদের ভালো ভালো খাবার যেমন পোলাও, মাংস, কোর্মা দেখলে জীবে জল আসে তাদের জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে এই গরমের দিনে। কারণ অতিরিক্ত গরমে এই ধরনের রিচ ফুড হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং বদহজম হয়ে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
দাওয়াতে গেলে বেশি খাবেন না
ধরে নিচ্ছি আপনি খেতে খুব ভালোবাসেন। তাই বলে গরমের দিন আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে কোন বিয়ে বাড়ি বা কোন দাওয়াতের অনুষ্ঠানে গেলেও বেশি খাওয়া যাবে না। অনেক সময় ওভার ইটিং এর কারণেও বদহজম হতে পারে।
ফাস্টফুড খাবেন না
বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে খাবারের তালিকায় সবার উপরে থাকে ফাস্টফুডের নাম। এই ধরনের ফাস্টফুডে অতিমাত্রায় থাকে বিভিন্ন ফ্যাট যা এই গরমের দিনে হজম হতে সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই তীব্র তাপদাহে সুস্থ থাকতে ফাস্টফুড পরিহার করুন।
যেকোনো ভিড়ে বা কনসার্টে থাকবেন না
যেকোনো ধরনের ভিড় যেমন শপিংয়ের ভিড়, কাঁচা বাজার করতে গেলে সেখানের ভিড়, কোথাও খেলা হচ্ছে সেখানে দর্শক গ্যালারির ভিড় অথবা কোন কনসার্টের ভিড় এড়িয়ে চলুন। তীব্র গরমের ভিতর এই ধরনের ভিড়ে অনেকক্ষণ অবস্থান করলে সাফোকেটিং বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি আপনার রক্তচাপ বেড়ে বা কমে যেতে পারে ফলে আপনি দ্রুত অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
যতটা সম্ভব এসি পরিহার করুন
বর্তমানের এই প্রযুক্তিগত আধুনিক যুগে গরমের দিনে এসি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না তবে এসি ব্যবহারে বিপত্তিটা মাথায় তখনই যখন আপনি অনেকক্ষণ স্প্রে থাকার পর হঠাৎ করে বাইরে একদম সরাসরি রোদের নিচে আসবেন। এমন পরিস্থিতিতে এসি রুমের তাপমাত্রা এবং বাইরে রোদের তাপমাত্রার হঠাৎ যে পরিবর্তন এতে আপনার ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই এসি রুম থেকে বের হয়ে কমপক্ষে ২০ মিনিট পরে রোদে যাওয়া উচিত।
ঠান্ডা বা ফ্রিজের খাবার পরিহার করুন
তীব্র গরমের তৃষ্ণা মেটাতে আমরা হর হামেশাই বিভিন্ন কোমল পানীয় বা সাধারণ পানি ফ্রিজ থেকে বের করে খাই। সুস্থ থাকতে চাইলে এই কাজটি একদমই করা যাবে না। কারণ বাইরে রোদ থেকে এসে হঠাৎ করে ঠান্ডা কোমল পানীয় বা ফ্রিজের ঠান্ডা সাধারণ পানি খেলে পেটের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য না হওয়ায় বিশেষ করে ঠান্ডা বা সর্দি লেগে যাওয়া, পেট ব্যাথা করা, টনসিল ফুলে গলা ব্যথা করা, বদহজম হওয়া, ডায়রিয়া হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের সমস্যা হয়।
রোদ থেকে এসেই পানি পান করবেন না
রোদ থেকে এসেই সাথে সাথে পানি পান না করে কমপক্ষে ১৫ মিনিট স্থির হয়ে বসুন। ফ্যান ছেড়ে স্থির হয়ে বসে ঘরের তাপমাত্রার সাথে আপনার শরীরের তাপমাত্রা একটা সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করুন। এরপর তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি পান করুন।
শেষ কথা
তীব্র তাপদাহকে অবহেলা না করে গুরুত্ব দেওয়া উচিত আমাদের সকলের। অতিরিক্ত গরমে যেকোনো সময় যেকোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই সব সময় গরম বা তাপমাত্রাকে মাথায় রেখে আমাদের ঘরে বাইরে কাজ পাওয়া উচিত।
ধৈর্য নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এ ধরনের আরো অনেক তথ্যবহুল লেখা পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করতে পারেন আর কোন মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url