শরীরের জন্য অপরিহার্য খনিজ উপাদান
আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে ভালো খাবার অর্থাৎ সুষম খাবার যেমন ফলমূল, সবজি, ডিম, দুধ এর পাশাপাশি ভিটামিন প্রয়োজন এটা আমরা সবাই জানি। তবে আমাদের শরীরের জন্য বেশ কিছু অপরিহার্য খনিজ উপাদান রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে আমাদের তেমন ধারণা নেই।
এই লেখায় আমরা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু খনিজ উপাদানের উৎস, কার্যাবলী এবং এসব খনিজের অভাবে কি কি সমস্যা হতে পারে সেসব বিষয় জানার চেষ্টা করব। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
খনিজ উপাদান
মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি খনিজ এক একটি রাসায়নিক উপাদান। আবার মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদানকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা যায় যার একটি হচ্ছে খনিজ উপাদান। বাকি তিনটি গ্রুপ হচ্ছে ভিটামিন, অ্যামাইনো এসিড এবং ফ্যাটি অ্যাসিড।
এই খনিজ উপাদান গুলিকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায় - মুখ্য খনিজ উপাদান এবং গৌণ খনিজ উপাদান। যে সমস্ত খনিজ উপাদান মানব দেহের জন্য অপরিহার্য অর্থাৎ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেগুলোকে বলা হয় মুখ্য খনিজ উপাদান। যেমন পটাশিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম।
আর যেসব খনিজ উপাদান শরীরে থাকলে ভালো, পুষ্টির চাহিদা পরিপূর্ণ হয় তবে অপরিহার্য নয় সেগুলোকে বলা হয় গৌণ খনিজ উপাদান। যেমন আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। গৌণ খনিজ উপাদান গুলোকে “ট্রেস উপাদান” বা “ট্রেস এলিমেন্টস” বলা হয়।
সোডিয়াম
উৎস:
লবণ, চিংড়ি, ঝিনুক এবং বিভিন্ন দুগ্ধ জাত খাবার সোডিয়ামের ভালো উৎস। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ১৩০০ থেকে ১৪০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম প্রয়োজন এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর দৈনিক ১২০০ থেকে ১৩০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম প্রয়োজন।
কার্যাবলী:
সোডিয়াম দেহের রক্ত ও পানির সমতা বজায় রাখে, স্নায়ুর চলাচল এবং কোষের কার্যক্রম ঠিক রাখে।
অভাবে যা হয়:
মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, মানসিক অবসাদ হওয়া, পেশিতে টান ধরা, দুর্বল অনুভূত হওয়া ইত্যাদি সমস্যা গুলো দেখা দেয়।
পটাশিয়াম
উৎস:
যেকোনো ধরনের বাদাম, পালং শাক, ডাবের পানি, বিভিন্ন ধরনের কলা, কমলালেবু ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক পটাশিয়ামের চাহিদা প্রায় ২০০০ মিলিগ্রাম।
কার্যাবলী:
পটাশিয়াম নিম্ন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তের তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, স্নায়ুতন্ত্র ও পেশি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অভাবে যা হয়:
পটাশিয়ামের অভাবে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
ফসফরাস
উৎস:
বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার, মটর, আলু, রসুন, শুকনো ফল, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, বিভিন্ন বাদাম, দই, আমড়া ইত্যাদি ফসফরাসের ভালো উৎস। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিগ্রাম ফসফরাস প্রয়োজন।
কার্যাবলী:
দাঁত ও হাড়কে মজবুত করা এবং শরীরে টিস্যু উৎপাদনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে থাকে ফসফরাস। তাছাড়া কিডনিকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি মস্তিষ্ককে সচল রাখে এবং অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে থাকে।
অভাবে যা হয়:
এক্ষুনির উপাদানের অভাবে হাড় ও জয়েন্টে ব্যথা, ক্লান্তি বোধ হওয়া, ক্ষুধা মন্দা হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
ক্যালসিয়াম
উৎস:
বিভিন্ন সবজি, সামুদ্রিক মাছ, দুধ, বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবার, মসুর ডাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক প্রায় ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা উচিত।
কার্যাবলী:
হাড়, জয়েন্ট, দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
অভাবে যা হয়:
শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় বিশেষ করে হাঁটু এবং হাতের হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে, দাঁত দুর্বল হয়ে পড়ে।
ম্যাগনেসিয়াম
উৎস:
প্রায় সব ধরনের বীজ যেমন কুমড়ার বীজ, বরবটির বীজ, সিমের বীজ, সব ধরনের বাদামে, মাছ, বিভিন্ন ফল যেমন কিসমিস, খেজুর ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন।
কার্যাবলী:
হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং হাড় ও দাঁতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ম্যাগনেসিয়ামের অবদান রয়েছে।
অভাবে যা হয়:
এই খনিজ উপাদানের অভাবে স্নায়ুর বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে, রক্তচাপ এবং হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আয়রন
উৎস:
লাল মাংস, মাংসের কলিজা, ডিম, সবুজ শাকসবজি বিশেষ করে কাঁচা কলা, শিম, পাকা কলা ইত্যাদিতে প্রচুর আয়রন বা লোহা রয়েছে। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক আয়রন প্রয়োজন প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম।
কার্যাবলী:
রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি এবং অক্সিজেন সরবরাহের মত জটিল কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আয়রন।
অভাবে যা হয়:
আয়রনের অভাবে শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অকারণে ঘন ঘন জ্বর হওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জিঙ্ক
উৎস:
সকল ধরনের বাদাম যেমন কাঠ বাদাম, চিনা বাদাম, সকল ধরনের দুগ্ধজাত খাবার, মাশরুম, গরুর মাংস, গরু-খাশি-মুরগির কলিজা এবং সব ধরনের সবজির বীজ যেমন সিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি, মিষ্টি কুমড়ার বীজ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে জিংক পাওয়া যায়। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক প্রায় ১৫ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয়।
কার্যাবলী:
সর্দি-কাশি ঠান্ডা, শরীরের যে কোন ব্যথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে জিংক।
অভাবে যা হয়:
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজে যে কোন রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও স্মৃতি শক্তির হ্রাস পায়, চুল পড়ে যায়।
ম্যাঙ্গানিজ
উৎস:
বিভিন্ন প্রকারের বাদাম, সবুজ শাকসবজি, বিভিন্ন শস্য দানা চা কফি ইত্যাদি বিভিন্ন খাবারে ম্যাঙ্গানিজ বিদ্যমান। পূর্ণবয়স্ক পুরুষের জন্য দৈনিক ২.৫ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ এবং একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর জন্য দৈনিক ২.০ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের শরীরে ১৫ থেকে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ম্যাঙ্গানিজ জমা থাকে।
কার্যাবলী:
শরীরের জন্য দরকারি বিভিন্ন এনজাইম সংক্রান্ত কার্যাবলী সম্পূর্ণ করার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ম্যাঙ্গানিজের। স্টার্চ, আমিষ, ফ্যাটি এসিডের শোষণে, হাড় শক্ত ও মজবুত করণে, রক্ত জমাট বাঁধতে, রক্তে শর্করের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে ম্যাঙ্গানিজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
অভাবে যা হয়:
ম্যাঙ্গানিজের অভাব শরীরের বিভিন্ন হাড়কে দুর্বল করে তোলে এবং হাড়ে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
আয়োডিন
উৎস:
বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, শৈবাল, আয়োডিনযুক্ত লবনে আয়োডিন বিদ্যমান। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দৈনিক আয়োডিনের চাহিদা প্রায় ১০০ মাইক্রগ্রাম এবং নারীর প্রায় ১৫০ মাইক্রগ্রাম।
কার্যাবলী:
আয়োডিন মানব দেহের থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে। তাছাড়া শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনে ভূমিকা রাখে এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
অভাবে যা হয়:
আয়োডিনের অভাবে শরীর দুর্বলতার পাশাপাশি গলগন্ড রোগ হয়।
কোবাল্ট
উৎস:
মাছ, ডিম, গরু ছাগলের কলিজা, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছ, বাঁধাকপি, ডাল জাতীয় শস্য দানা ইত্যাদিতে কোবাল্ট বিদ্যমান। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ০.০০০১ মিলিগ্রাম কোবাল্ট দরকার।
কার্যাবলী:
কোবাল্ট রক্তের লোহিত রক্ত কনিকা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের এনজাইম সরবরাহ করে থাকে।
অভাবে যা হয়:
এটির অভাবে শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, মানসিক অশান্তি, হজমের সমস্যা, থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা, হৃদরোগের সমস্যা, হাত পায়ের অসাড়তা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সেলেনিয়াম
উৎস:
দেহের জন্য দরকারি ট্রেস এলিমেন্ট গুলোর মধ্যে সেলেনিয়াম অন্যতম। ডিম মাছ গরু ছাগল হাঁস মুরগির মাংস বাদাম শাকসবজি ইত্যাদি থেকে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন প্রায় ৫০ মাইক্রগ্রাম সেলেনিয়াম প্রয়োজন হয়।
কার্যাবলী:
এটি থাইরয়েড হরমোনের কার্যাবলী ও প্রজনন ক্ষমতা তদারকি করার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ রোধ করে থাকে।
অভাবে যা হয়:
সেলেনিয়ামের অভাবে হৃদরোগ এবং মানসিক সমস্যার পাশাপাশি মাংসপেশীতে ব্যথা হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
কপার
উৎস:
সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার যেমন শাকসবজি, যেকোনো সবজির বীজ, ফলমূল, গরু খাসির মাংস-কলিজা, সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কপার বা তামা বিদ্যমান। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ মাইক্রগ্রাম তামা প্রয়োজন শরীরের জন্য।
কার্যাবলী:
তামা ত্বকের রং স্বাভাবিক রাখে, স্নায়ুর সংকেত সারা শরীরে আদান-প্রদানের সাহায্য করে, রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হতে সাহায্য করে। তাছাড়াও এটি মানবদেহের বিকাশে সাহায্য করে।
অভাবে যা হয়:
এর অভাবে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, রক্তের শ্বেত কণিকার পরিমাণ কমে যায়, চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
ফ্লোরিন
উৎস:
পানি ফ্লোরিনের অন্যতম উৎস হলেও চা, কফি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবারে ফ্লোরিন বিদ্যমান। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক চার থেকে পাঁচ মিলিগ্রাম ফ্লোরিন প্রয়োজন।
কার্যাবলী:
হাড় ও দাঁত কে মজবুত রাখে।
অভাবে যা হয়:
ফ্লোরিন এর অভাবে হাড় ও দাঁত দুর্বল হয়।
শেষ কথা
শরীর আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। শরীর সুস্থ্য না থাকলে আমাদের জীবনটাই বৃথা। তাই শরীর সুস্থ রাখতে সুষম খাবার এবং ভিটামিনের পাশাপাশি খনিজ উপাদানের প্রতিও আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় একই রকম খাবার আইটেম না রেখে এক এক দিন এক এক রকমের খাবার রাখলে সব রকমের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
আশাকরি বিভিন্ন খনিজ উপাদান নিয়ে কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছেন। লেখাটি ভালো লেগে থাকলে অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারেন আর নতুন কিছু জানার আগ্রহ থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url