আসল-নকল টাকা চেনার উপায়- জাল টাকা পেলে করণীয়

টাকা ছাড়া পৃথিবী অচল। আমাদের যে কোন কাজ করতে গেলেই টাকার লেনদেন করতে হয়। তবে বিপত্তি তখনই বাধে যখন আসল টাকার মধ্যে কিছু নকল টাকা থেকে যায়। বিড়ম্বনাই পড়ি কারণ আমরা অনেকেই আসল-নকল টাকা চেনার উপায় জানি না।
আসল-নকল টাকা চেনার উপায়- জাল টাকা পেলে করণীয়

জাল টাকা চেনার উপায় এবং জাল টাকা পেলে করণীয় সহ আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানবো এই লেখায়। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

জাল টাকা

জাল টাকা অর্থ নকল টাকা বা যেটা আসল নয়। জাল টাকা বা নকল টাকাকে ইংরেজিতে বলা হয় fake currency, counterfeit coin ইত্যাদি। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনবরত জাল টাকা উৎপাদন, ব্যবহার এবং লেনদেন করে থাকে। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও জাল বা নকল  টাকা সম্পর্কিত যেকোনো কার্যকলাপ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধ রুখতে এবং নিজেদের সতর্ক রাখতে আমাদের অবশ্যই আসল-নকল টাকা চেনার উপায় জানা উচিত। 

আসল-নকল টাকা চেনার উপায়

যেসব অসাধু লোক জাল টাকা বা নকল টাকা তৈরি করে তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তৈরি করে। এই কারণে সাধারণ অবস্থায় দেখে বোঝা যায় না যে সেটি আসল নাকি নকল টাকা। তাই জাল টাকার ঝুঁকি এড়াতে আসল-নকল টাকা চেনার উপায় গুলো জানা জরুরি। চলুন উপায় গুলো জেনে নেই। 
  • নতুন বা পুরাতন হোক আসল নোট সব সময় খসখসে হয় কিন্তু জাল নোট সব সময় মসৃণ হয়।
  • নকল টাকার জলছাপ সব সময় অস্পষ্ট হবে। যেখানে আসল নোটের ‘বাঘের মাথা’ ও ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম’ স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়।
  • প্রতিটি নোটেই বাংলাদেশের লোগো যুক্ত একটি নিরাপত্তা সুতা থাকে। এই সুতাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি সহজে চেনা যায় না বা নখের আঁচড়ে এটিকে নষ্ট করা যায় না। জাল টাকায় এ ধরনের সুতা থাকলেও সেটি কাগজের সাথে সহজে নষ্ট হয়ে যায়।
  • ১০০, ২০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকার মূল্য মানের প্রত্যেক নোটে উপরের দিকে ডানদিকে ইংরেজি সংখ্যায় টাকার মূল্যমান। লেখা থাকে। এটি এমন কালিতে লেখা থাকে যাতে নোটটি নড়াচড়া করলে এর রং পরিবর্তন হয়। জাল নোটেও ঠিক এইভাবে রঙিন কালি দিয়ে লেখা থাকলেও কাগজ নড়াচড়ার সময় রং পরিবর্তন হয় না।
  • বাংলাদেশের প্রচলিত সকল টাকার নোটেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, নোটের মূল্যমান জলছাপ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম মুদ্রিত থাকে। নকল নোটে এসব উজ্জ্বলভাবে কিছুই থাকবে না বা থাকলেও অস্পষ্ট।
  • প্রতিটা নোটের বাম পাশে লম্বা লম্বি ভাবে যে রেখাটি বা সুতাটি থাকে সেটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে এর ভেতরের “বাংলাদেশ ব্যাংক” লেখাটি স্পষ্ট বোঝা যাবে যেটি জাল নোটে বোঝা যাবে না।
  • আসল নোটের প্রতিটা লেখায় হাত দিয়ে স্পর্শ করলে উঁচু-নিচু অনুভূত হয় নকল নোটে যেটা একদম সমতল বা সমান মনে হবে।
  • টাকার বাম এবং ডান দিকে ফুলের নকশা রয়েছে যেটি দুই পৃষ্ঠে একই জায়গায় একইভাবে বসানো আছে নকল নোটে যা বসানো প্রায় অসম্ভব। আসল টাকায় আলোর বিপরীতে এর জলছাপটি স্পষ্ট দেখা যায়।
  • প্রতিটা নোটের গায়ে অনেক বার স্পষ্টভাবে অতি ক্ষুদ্র আকারে “Bangladesh Bank” কথাটি লেখা আছে। এটি শুধুমাত্র আসল টাকার ক্ষেত্রে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে স্পষ্ট ভাবে দেখা সম্ভব। জাল টাকায় লেখাগুলোকে রেখার মতো মনে হবে।
  • প্রতিটি টাকার নোটের সামনের দিকে ডান দিকের কিছুটা উপরে তির্যক বেশ কয়েকটি দাগ টানা থাকে যেগুলো আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এগুলো উঁচু হয়ে আছে। নকল নোটে এ ধরনের দাগ থাকলেও হাতে স্পর্শ করলে একদমই সমান মনে হবে।
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করার পরেও যদি আসল এবং জাল টাকা শক্ত করতে অসুবিধা মনে হয় তবে ইউভি রশ্মির সাহায্যে সহজেই আসল বা নকল টাকা সনাক্ত করা সম্ভব।

ইউভি রশ্মি ব্যবহারে জাল টাকা শনাক্তকরণ

জাল টাকা সনাক্ত করার আরেকটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে ইউভি (UV) রশ্মি বা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ব্যবহার করা। বর্তমানে বাজারে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি নির্গত করে এরকম বিভিন্ন যন্ত্র কিনতে পাওয়া যায়। টাকার উপরে বিশেষ কিছু কালি দেওয়া থাকে যেটি সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না। তবে এ কালির মধ্যে এমন কিছু ফ্লোরোসেন্স উপাদান থাকে যার উপরে নির্দিষ্ট রশ্মি পড়লে সেটি প্রতিফলিত করে তখন সেটা দেখা যায়। 
একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি সেই কালির উপর পড়লে রশ্মির সাথে সেই কালিতে থাকা ফ্লোরোসেন্স বিক্রিয়া করে ফলে সেটি প্রতিফলিত হয় আর সেটি আমাদের চোখে তখন দৃষ্টিগোচর হয়। আল্ট্রাভায়োলেট রশির মাধ্যমে কালিতে থাকা অতি সূক্ষ্ম কোন লেখা যখন এভাবে দেখা যাবে তখন নিশ্চিত হওয়া যায় সেটি আসল টাকা। নকল বা জাল টাকাতে এটির দেখা সম্ভব নয়।

জাল টাকা পেলে করণীয়

বর্তমান আধুনিক যুগে আমরা শুধু ব্যক্তির সাথে লেনদেন করি তা নয়, এটিএম বুথ থেকেও আমরা টাকা উত্তোলন করে থাকি। তাই জাল টাকার আদান প্রদান শুধু ব্যক্তির মাধ্যমে নয় এটিএম বুথের মাধ্যমেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দুই ভাবে আমরা জাল টাকা পেতে পারি এবং দুই উপায়ে জাল টাকা পেলে করণীয় কি হবে আমাদের সে বিষয়ে এখন আলোচনা করব।

কোন ব্যক্তির কাছে জাল টাকা পেয়ে থাকলে এবং ব্যক্তিটিকে আপনার সন্দেহজনক মনে হলে জাল টাকাসহ সেই ব্যক্তিটিকে পুলিশে দিতে হবে। অর্থাৎ দ্রুত নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সে ব্যক্তি যে আপনাকে জাল টাকা দিয়েছে তার স্বপক্ষে প্রমাণ দেখাতে হবে। 

তবে আপনি যদি বুঝতে পেরে থাকেন যে জাল টাকার প্রদানের বিষয়টি সেই ব্যক্তির অজান্তে হয়েছে অর্থাৎ সে ব্যক্তি জাল টাকার কোন রকম অপরাধের সাথে জড়িত নয় সে ক্ষেত্রে আসলে করার তেমন কিছুই নেই। আপনিও একজন ভুক্তভোগী সে ব্যক্তিও ঠিক একই রকম ভুক্তভোগী। 
নিজেদের ক্ষতি ভেবে জাল নোটটিকে সেই স্থানে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জাল টাকার সব রকম বৈশিষ্ট্য সে ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থানায় গিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিবেন।

এবার আসা যাক এটিএম বুথ থেকে জাল টাকা পেলে কি করবেন?
  • টাকা উত্তোলনের পর যদি দেখেন যে আপনার হাতে থাকা টাকাগুলোর মধ্যে একটি, দুটি অথবা বেশ কয়েকটি নোট জাল তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই জাল নোটগুলো বুথের ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরার সামনে ধরুন। সিসি ক্যামেরার সামনে নোটগুলোকে এমন ভাবে ধরুন যেন টাকার প্রত্যেকটি লেখা বা নম্বর স্পষ্ট বোঝা যায়।
  • এরপর বুথে কর্তব্যরত অফিসার থাকলে তাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানান। প্রয়োজনে লিখিতভাবে অভিযোগ করুন।
  • তারপর এটিএম বুথে কর্তব্যরত অফিসারের কাছ থেকে কোন রকমের প্রমাণসহ কোন কাগজপত্র পেলে সেটি এবং আপনার জাল টাকা সহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে জানান।
  • সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে আপনাকে একটি ফর্ম দেওয়া হবে, সে ফর্মটি চাহিদা মত তথ্য দিয়ে পূরণ করে ব্যাংকে জমা দিন।
  • ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করে আপনার ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেলে আপনাকে জাল টাকার পরিবর্তে আসল টাকা প্রদান করতে পারে।

জাল মুদ্রা প্রতিরোধ আইন ২০২২ অনুযায়ী শাস্তি

অর্থ মন্ত্রণালয় জাল টাকা এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ দমনের জন্য “জাল মুদ্রা প্রতিরোধ আইন ২০২৩” নামে একটি নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এ আইন অনুযায়ী জাল টাকা সংক্রান্ত অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে এবং তার সাথে জাল টাকার মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তির দ্বিগুণ অথবা এক কোটি টাকা- এ দুটোর মধ্যে যেটা বেশি হবে সেটি জরিমানা করা হবে।
জরিমানা অনাদায় আরো পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এর আগে “বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪” অনুযায়ী জাল টাকা সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি থাকলেও কোন অপরাধের জন্য কি পরিমান শাস্তি সেটা উল্লেখ ছিল না। তবে বর্তমানের খসড়া আইনে সাত ধরনের অপরাধের উল্লেখিত শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
  1. টাকা জাল করা অথবা জেনে শুনে টাকা জাল করার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থেকে যে কোনো কার্যসম্পাদন করা।
  2. জাল টাকা জানা সত্ত্বেও সেটি মজুদ, ব্যবহার, কেনাবেচা, দান, গ্রহণ বা অন্য কোন ভাবে তাকে আসল টাকা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা।
  3. জাল টাকা তৈরির কাজে ব্যবহার করার উদ্দেশে কোন যন্ত্র, হাতিয়ার, সরঞ্জাম, উৎপাদন সামগ্রীর ব্যবহার বা ক্রয় করা।
  4. জাল টাকা হেফাজত করা, ব্যবহার করা, সরবরাহ করা, আমদানি রপ্তানি করা, মেরামত বা বহন করা, কেনাবেচা করা।
  5. জাল টাকা তৈরি সংক্রান্ত যে কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন বা এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য অন্যের সাথে আদান প্রদান করা।
  6. জাল টাকা তৈরি সম্পর্কিত ফাইল, কাগজপত্র, নোট, অডিও বা ভিডিও ক্লিপ এর হার্ডকপি বা সফট কপি সংরক্ষণ করা।
  7. জাল মুদ্রা দেশ থেকে বিদেশে অথবা বিদেশ থেকে দেশে সরবরাহ বা পাচার করা এবং মিসম্যাচড বা ব্লিচড মুদ্রা ব্যবহার, বেচাকেনা, লেনদেন বা বহন করা।
এছাড়াও আসল টাকা বা নকল টাকা সম্পর্কিত যেকোন গুজব ছড়ালে সেটিকেও এই অপরাধের আওতায় এনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তবে এক্ষেত্রে শাস্তি কিছুটা কম হবে অর্থাৎ ১০ বছরের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম করাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হবে।
আসল-নকল টাকা চেনার উপায়- জাল টাকা পেলে করণীয়

এটিএম বুথ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন

  • এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সময় সব সময় নিজে তুলুন। অন্য কারো সাহায্য নিবেন না অথবা অন্য কাউকে দিয়ে টাকা তোলাবেন না।
  • এটিএম মেশিনে পিন দেওয়ার সময় হাত দিয়ে ঢেকে রাখুন যাতে পাশের মেশিনের থাকা কোন ব্যক্তি আপনার পিন কোড জানতে না পারে।
  • একান্ত নিজের পরিবারের কেউ ছাড়া অন্য কারো হাতে আপনার এটিএম কার্ড দেবেন না।
  • ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মচারী বা কোন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট কারো কাছে আপনার কার্ডের পিন নম্বর দিবেন না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কখনো আপনার কাছ থেকে এটিএম কার্ডের পিন চাইবেনা।
  • কখনো আপনার এটিএম কার্ড হারিয়ে গেলে সাথে সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন এবং নিকটবর্তী থানায় একটি জিডি করে রাখুন।
  • টাকা তোলার পর মেশিন থেকে যে স্লিপ দেওয়া হয় সেটি সাথে সাথে এমন ভাবে ছিড়ে ফেলুন যাতে কাগজের ছায়া টুকরো থেকে কেউ কোনো তথ্য নিতে না পারে। অথবা স্লিপটি আপনার বাসায় এসে নষ্ট করে ফেলুন। এই স্লিপে আপনার একাউন্ট সম্পর্কে অনেক তথ্য দেয়া থাকে।
  • টাকা উত্তোলনের পর টাকা তোলার শুরুতে যে স্ক্রিন ছিল সেই স্ক্রিন না আসা পর্যন্ত এটিএম মেশিনের সামনে থেকে স্থান ত্যাগ করবেন না।

শেষ কথা

ইচ্ছাকৃতভাবে জাল বা নকল টাকা ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। আমাদের দৈনন্দিন লেনদেনে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে, আসল টাকা শনাক্ত করে লেনদেন করতে হবে।
যাইহোক, আসল-নকল টাকা চেনার উপায় এবং জাল টাকা পেলে করণীয় কি সেই বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করলাম। এতক্ষণ ধরে ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন আর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url