ডেঙ্গু রোগের কারণ- লক্ষণ এবং করণীয়


আমাদের দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু একটি আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো আমরা অনেকেই জানিনা ডেঙ্গু রোগের কারণ- লক্ষণ কি কি। 
ডেঙ্গু রোগের কারণ- লক্ষণ এবং করণীয়

শুধু তাই নয় আমাদের মধ্যে অনেকের সচেতনতার অভাবের কারণে হোক অথবা অজ্ঞতার কারণে হোক আমরা আমাদের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখিনা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে আমাদের কি করণীয় সে বিষয়েও আমরা ওয়াকিবহাল নই। এই লেখায় ডেঙ্গু রোগের বিস্তারিত সম্পর্কে জানব, আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

ডেঙ্গু রোগ

ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক হচ্ছে এডিস ইজিপটাই স্ত্রী মশা। এই এডিস মশা সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ দিনের বেলায় রক্তপানের জন্য বিভিন্ন শরীরে কামড় দেয়। এই মশা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বা জিকা ভাইরাসও বহন করে থাকে। 
জানেন কি স্মার্টফোন আমাদের শরীরে কি কি ক্ষতি করছে?
এই মশার বাহ্যিক আবরণ অন্য মশার চাইতে কিছুটা আলাদা। এডিস মশার শরীরে স্পষ্ট সাদা রঙের ডোরাকাটা থাকে। এইজন্য এ মশাকে “টাইগার মশাও” বলা হয়। এডিস মশার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এরা একদম স্বচ্ছ পানিতে খুব দ্রুত সময়ে বংশবিস্তার করতে পারে। মে-জুন থেকে অগাষ্ট সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

ডেঙ্গু রোগের কারণ

এডিস ইজিপ্টাই স্ত্রী মশা সাধারণত ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত কোন ব্যক্তির শরীরে এই এডিস মশা কামড় দিলে মশার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এই মশা যখন কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে কামড় দেয় তখন এই মশার শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তি শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে সুস্থ ব্যক্তি সহজেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এডিস মশা নিধনের ব্যবস্থা না করা। আমাদের বাসার ভেতরে এবং বাইরে ডোবা নালা, পানি জমে থাকে এমন কোন কিছু পরিষ্কার না করার ফলে সেগুলোতে এডিস মশা সহজে বংশ বিস্তার করতে পারে এবং রাতে দিনে যেকোনো সময় আমাদেরকে কামড় দেয়ার ফলে আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হই।
ডেঙ্গু রোগের কারণ- লক্ষণ এবং করণীয়

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

  • ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়।
  • ডেঙ্গু রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো শরীরের প্রচণ্ড জ্বর থাকার কারণে পেশি এবং হাড়ের জয়েন্টে প্রচন্ড ব্যথা হয়।
  • প্রচন্ড মাথা ব্যথা হয় বিশেষ করে চোখের পেছনে ব্যথা হয়।
  • মুখ এবং গলা শুকিয়ে যায় এবং পানির পিপাসাও বেড়ে যায়।
  • বমি বমি ভাব হয় অনেক সময় বমি হয়ে যায়, খাবারে প্রচুর অরুচি দেখা যায়।
  • তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় শরীরে রেশ বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
  • পেটে ব্যথা হতে পারে, ডায়রিয়াও হতে পারে।
  • শরীরের যে কোন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে বিশেষ করে নাক এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে।
  • ক্ষেত্রবিশেষে কারো কারো পেটে পানি জমতে পারে তার সাথে শরীরে খিচুনিও হতে পারে।
  • রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় দুর্বলতা বেড়ে যায় এবং রোগী মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়।
  • রক্তচাপ অনেক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করে- কখনো খুব বেড়ে যায় আবার কখনো কমে যায়।

ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির করণীয়

কোন ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার বিশেষ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় সেগুলো আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে জীবন বাঁচাতে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর কি করনীয় সেটা অবশ্যই জানা উচিত।
  1. সবার প্রথমে অবশ্যই ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, শরীরের প্রচন্ড জ্বর থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথা বা জ্বর কমানোর উদ্দেশ্যে সামান্য প্যারাসিটামল পর্যন্ত খাওয়ানো যাবে না।
  2. প্রাথমিক অবস্থায় যদি ডেঙ্গু রোগীকে সনাক্ত করা না যায় তবে ধীরে ধীরে রোগী মারাত্মক খারাপ অবস্থায় পরিণত হতে পারে। থেকে “ডেঙ্গু শক সিনড্রোম” বলে। এ অবস্থায় রোগীর শরীরে ব্যাপক পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তাই রোগীকে এ অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার দিতে হবে যেমন ফলের রস, বিভিন্ন সুপ ইত্যাদি।
  3. ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই আলাদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শীতল পরিবেশে রাখতে হবে এবং মনে রাখতে হবে দিনে রাতে সব সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
  4. ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের অনুচক্রিকা তথা প্লাটিলেট আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। প্লাটিলেট বৃদ্ধির জন্য রোগীকে প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি এবং ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে।
  5. প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর রোগীর জ্বর মারতে হবে এবং চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে এই রিপোর্টটি চিকিৎসককে জানাতে হবে।
  6. ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তচাপ কমে বা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে তাই জ্বর মাপার পাশাপাশি দুই ঘন্টা পর পর রক্তচাপ মাপাও জরুরী।
  7. ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি যেন পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয় সেদিকে পরিবারের অন্য সদস্যদের খেয়াল রাখতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের ঔষধ

সাধারণ জ্বর বা যে কোন ভাইরাল ফিভারে জ্বর বা ব্যথা কমানোর জন্য সাধারণত প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেলেই চলে। তবে ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন ধরনের ওষুধ খাওয়া যাবেনা। প্যারাসিটামল না খাওয়ায় উত্তম তবে অ্যাসপিরিন জাতীয় কোন ওষুধ একদম খাওয়া যাবে না। 
অপ্রয়োজনে কোনো ওষুধ খেলে হিতে বিপরীত হয়ে অবস্থা আরো জটিলতার হতে পারে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া ঠিক করলে এবং পর্যন্ত বিশ্রাম নিলে ডেঙ্গু জ্বর স্বাভাবিকভাবেই সেরে যেতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে তিনি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিবেন।

ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার

খুব প্রচলিত একটি কথা আমরা সবাই জানি, প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যাবার পরে সুস্থ হওয়ার চেয়ে ডেঙ্গুতে যেন আক্রান্ত না হওয়া যায় তার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। বিভিন্ন উন্নত দেশে ডেঙ্গুর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। 

একটা সন্তোষজনক ফল পাবার জন্য তারা বেশ কিছু গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষেধক টিকা ব্যবহার করেছেন। তবে চূড়ান্ত ফল পাওয়ার জন্য আমাদের এখনো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক আমাদের সাধ্যের মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।
  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশারি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অবহেলা আমাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
  • আমাদের বাসার ভেতরে, বারান্দায়, বাথরুমে, রান্নাঘরে যেকোনো জায়গায় খোলা পাত্রে পানি জমে আছে কিনা, ফুলের টবে পানি জমে আছে কিনা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। পানি জমে থাকলে অবশ্যই সেটা প্রত্যেকদিন ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
  • শুধু বাসার ভেতরে নয় বাসার বাইরেও আশেপাশে নষ্ট টায়ার, ফুলের টব, এয়ার কুলার, ডাবের খোসা, কোন পুকুর ডোবা ইত্যাদি থাকলে সেগুলোতে পানি জমে থাকলে অবশ্যই সেগুলো পরিষ্কার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • বাসার ভেতরে ঘুমানোর আগে বিভিন্ন স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে।
  • আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে হাত এবং পা যতটা সম্ভব ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ফুলহাতা জামা বা ফুল পায়জামা পরার চেষ্টা করতে হবে।
  • শিশুদেরকে অবশ্যই সব সময় মশারির ভেতরে রাখতে হবে।
  • যদিও ডেঙ্গু কোন ছোঁয়াচে রোগ নয় তারপরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখা উত্তম। আক্রান্ত ব্যক্তি কে মশার কামড়ের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • রক্তদান বা গ্রহণের সময় অবশ্যই রক্ত ভালোমতো পরীক্ষা করে গ্রহণ বা দান করতে হবে।

ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেটের প্রভাব

মানুষের শরীরে রক্তের তিনটি বিশেষ উপাদান থাকে- লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্লাটিলেট এর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্লাটিলেট বাড়তে পারে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর একজন ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে যখন তার শরীরে রক্তের প্লাটিলেট এবং ইলেকট্রোলাইট এর ভারসাম্য বজায় থাকে না।

ডেঙ্গু জ্বর এবং সাধারণ জ্বরের পার্থক্য

  • সাধারণ জ্বর, যেটি ভাইরাস জ্বর নামেও পরিচিত, সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রম এর মাধ্যমে অথবা সাধারণ কোন মশার কামড়ে হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে ডেঙ্গু জ্বর একটি সুনির্দিষ্ট মশার কামড়ে হয়ে থাকে যেটির নাম হচ্ছে “এডিস ইজিপটাই”।
  • সাধারণ জ্বরের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা গলা ব্যথা শরীর দুর্বলতা ইত্যাদি। অন্যদিকে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ গুলোর মধ্যে রয়েছে চোখের পিছনে ব্যথা, বমি বমি ভাব, রেশ বা ফুসকুড়ি ওঠা, নাক ও মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি।
  • সাধারণ জ্বর তিন থেকে চার দিন স্থায়ী হয় যেখানে ডেঙ্গু জ্বর ১ সপ্তাহ বা তার বেশিও স্থায়ী হতে পারে।
  • সাধারণ জ্বরে জয়েন্ট ও পেশিতে ব্যথা হয় তবে ডেঙ্গু জ্বরে জয়েন্ট ও পেশির ব্যথা তীব্রতর হয়।
  • সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির তাপমাত্রা ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর মধ্যে থাকে। তবে ডেঙ্গুজোর আক্রান্ত ব্যক্তির তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে
ডেঙ্গু রোগের কারণ- লক্ষণ এবং করণীয়

শেষ কথা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার সবচাইতে সহজ উপায় হচ্ছে সচেতনতা সৃষ্টি করা। নিজেকে সচেতন হতে হবে, পরিবারের সবাইকে সচেতন করতে হবে, প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে সর্বোপরি দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। আমাদের আশেপাশের মানুষ যদি ডেঙ্গু মুক্ত হয় তবে আমাদেরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
লেখাটি পড়ে বিন্দুমাত্র যদি উপকৃত হয়ে থাকেন তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর আরো নতুন কিছু জানার আগ্রহ থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url