রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে যা খেতে পারেন
কোন ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই আতঙ্কিত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি না করে মাথা ঠান্ডা রেখে রোগীকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খেলে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে ডেঙ্গু ভালো হয়ে যেতে পারে। তবে সমস্যা বাঁধে রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে। আমরা অনেকেই জানি না প্রাকৃতিক ভাবে রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে কি কি খাবার খাওয়া যেতে পারে।
রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে হাসপাতালে যেতে না চাইলে এসব প্রাকৃতিক খাবারের উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো কি কি খাবার খেলে সহজে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বেড়ে যায়। আশা করি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
রক্তের প্লাটিলেট
আমাদের শরীরের রক্ত প্রধানত তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত - লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা এবং অনুচক্রিকা। অনুচক্রিকাকে প্লাটিলেট বলা হয়। এর অপর নাম থ্রমবোসাইট। অনুচক্রিকার প্রধান কাজ হল রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করা এবং রক্তক্ষরণে বাধা প্রদান করা। অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট বর্ণহীন এবং নিউক্লিয়াসবিহীন, চাকতি আকৃতির একটি উপাদান।
সুস্থ মানুষের শরীরে স্বাভাবিক পরিমাণে অনুচক্রিকা থাকলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে অনুচক্রিকার পরিমাণ আশঙ্কা জনক ভাবে কমতে শুরু করে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয় এবং জটিলতার সৃষ্টি হয়।
রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণ
সাধারণত ভাইরাস এর সংক্রমণ যেমন হেপাটাইটিস বি, কভিড ১৯, ডেঙ্গু ইত্যাদির কারণে রক্তের প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ থাকলে বেশ কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে রক্তের প্লাটিলেট কমতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ক্যান্সারের কেমোথেরাপির কারণে রক্তের প্লাটিপ্লেট অনেক সময় কমে যায়।
ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কত থাকে
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে একজন মানুষের অন্যতম জটিলতা হলো রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তে অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের স্বাভাবিক মাত্রা হলো প্রতি মিলি লিটারে ১৫০০০০ থেকে ৩০০০০০।
ডেঙ্গু রোগীর এই প্লাটিলেটের সংখ্যা হঠাৎ করে দ্রুত কমতে শুরু করে। একজন ডেঙ্গু রোগীর রক্তে এই প্লাটিলেট যদি মাত্র ১৫০০০ বা তার কম থাকে তবে তা রোগীর জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। এই অবস্থায় কাল বিলম্ব না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
রক্তে প্লাটিলেট বাড়ানোর উপায়
ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত তেমন কোন টিকা আবিষ্কার হয়নি, নেই সাধারণ কোন ওষুধ। তবে প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা যদি খুব বেশি মাত্রায় কমে যায় তবে রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসক প্রয়োজনে অন্য ব্যক্তির শরীরের রক্ত থেকে অনুচক্রিকা গ্রহণের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাটিলেট বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। এ ব্যবস্থা সাধারণত দুটি উপায়ে করা যেতে পারে।
প্রথম পদ্ধতির নাম হচ্ছে আরডিপি (Random Doner Platilate)। এতে একসাথে পাঁচ থেকে ছয় জনের রক্ত নিয়ে মেশিনের মাধ্যমে রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাটিলেট প্রদান করা হয়। অনুচক্রিকা বেড়ে যাওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
দ্বিতীয় পদ্ধতির নাম হচ্ছে আফারেসিস। এ প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নেয়ার পর মেশিনের মাধ্যমে সেখান থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে বাকি দুইটা অংশ অর্থাৎ লোহিত রক্ত কণিকা এবং শ্বেত রক্তকণিকা পুনরায় রক্ত দাতাকে দিয়ে দেয়া হয়।
এক্ষেত্রে রক্তদাতা কে পরিপূর্ণ সুস্থ থাকতে হবে এবং তার রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ প্লাটিলেট থাকতে হবে। প্লাটিলেট আদান-প্রদানের এই পদ্ধতিটি সম্পন্ন হতে এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগে। এই পদ্ধতিতে প্লাটিলেট গ্রহণের সময় কম লাগলেও পদ্ধতিটি অনেক ব্যয়বহুল।
রোগীকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে
ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থা থেকে চিকিৎসা নিলে রোগী খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। তবে প্রথম থেকে সচেতন থাকার পরেও রোগী যদি আরোগ্য লাভ না করে তবে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
- আক্রান্ত রোগীর শরীরের যেকোনো অংশে কেটে না গেলেও রক্তক্ষরণ শুরু হলে।
- হার্টবিট অত্যন্ত বেড়ে গেলে এবং রক্তচাপ খুব দ্রুত কমে গেলে।
- শরীর নিলাভ এবং ঠান্ডা হয়ে আসলে।
- রোগী নিজে থেকে যেকোনো খাবার খেতে না পারলে।
- বমির সাথে প্রচন্ড পেটে ব্যথা অনুভব করলে।
- পেটে পানি জমে ফুলে গেলে
- রক্তে অনুচক্রিকার মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেলে।
- পায়খানার সাথে, মাড়ি দিয়ে, নাক দিয়ে,প্রস্রাবের সাথে রক্তক্ষরণ শুরু হলে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব
কোন কোন ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক অবস্থায় কোন উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় না ফলে অনেকে এটিকে সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করে। এরপর প্রাথমিক অবস্থা থেকে ডেঙ্গু জ্বর যখন হেমোরেজিক অবস্থায় চলে যায় তখন মৃত্যুর আশঙ্কা কিছুটা বেড়ে যায়। এর থেকেও মারাত্মক অবস্থা হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম যেটিতে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় ৫ থেকে ৭ পার্সেন্ট বেড়ে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে ডেঙ্গু জ্বরে ভুগলে মাথার চুল পড়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অসুখসহ নানারকম জটিলতা দেখা দেয়। ডেঙ্গু প্রাণনাশক হয়ে ওঠে ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগীদের জন্য।
প্রাকৃতিক উপায়ে কোন খাবারে প্লাটিলেট বাড়ে
মিষ্টি কুমড়া
খুবই পরিচিত রঙ্গিন একটি সবজি মিষ্টি কুমড়া। ভিটামিন এ এর ঘাটতি মেটানোর পাশাপাশি অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট বাড়াতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে মিষ্টি কুমড়া। শুধু তরকারি হিসেবেই নয় মিষ্টি কুমড়া ভর্তা করে, মিষ্টি কুমড়া জুস করেও খাওয়া যায়।
ডাব
ডেঙ্গু জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করতে চাইলে ইলেকট্রোলাইটস এবং প্লাটিলেট এর ভারসাম্য বজায় রাখার জরুরি। ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ এবং ইলেকট্রোলাইটস থাকে। যে কোন বয়সের মানুষ ডাবের পানি খেতে পারে। ডাবের পানি একটি সুস্বাদু পানীয়।
পালং শাক
পালং শাক রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ করে থাকে। পালং শাক খুবই সহজলভ্য এবং সুস্বাদু একটি সবুজ সবজি। এছাড়া পালং শাকে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড।
বেদানা
বেদানা কিছুটা দামি হলেও অত্যন্ত দরকারী এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি পরিচিত ফল। আমরা মোটামুটি সবাই জানি রক্ত চাহিদা মেটাতে অথবা রক্ত বৃদ্ধি করতে বেদনা খাওয়া হয়। বেদানা শুধু লোহিত রক্তকণিকা বৃদ্ধি করে তা নয় তার সাথে অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে। তাছাড়া বেদানাতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, বিভিন্ন খনিজ উপাদান, ভিটামিন সি রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের দুর্বলতা কাটাতে সক্ষম।
রসুন
নিত্য প্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত দরকারি এই মসলাটি রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন দুই-তিন কোয়া রসুন সরাসরি কাঁচা চিবিয়ে খেতে পারেন অথবা তরকারিতে রসুন রান্না করে খেতে পারেন অথবা রসুনের চপ করেও খেতে পারেন।
গাজর
রঙ্গিন এবং সুস্বাদু এ ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ। তাই দৃষ্টিশক্তি উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। গাজর সুস্বাদু মিষ্টি হওয়ায় সবারই খুব পছন্দের একটি ফল। গাজর তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায় অথবা কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া যায়। আবার সালাদ করেও গাজর খেতে পারেন। তাছাড়া গাজরের জুস এবং গাজরের হালুয়া খুবই পরিচিত দুটি খাবার।
পেঁপে
পেঁপের পাশাপাশি পেঁপে পাতাও প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম। ভর্তা বা রান্না করে অথবা জুস করে পেঁপে খেতে পারেন। তাছাড়া পাকা পেঁপে একটি সুমিষ্ট উপদেয় ফল।
ব্রকলি
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং বিভিন্ন খনিজ সমৃদ্ধ ব্রকলিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন কে যা প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিসমিস
আয়রন সমৃদ্ধ কিসমিস প্লাটিলেট বাড়ানোর পাশাপাশি শরীরে এনার্জি বৃদ্ধি করে। বাজারের খুবই সহজলভ্য একটি খাবার কিসমিস। কিসমিস পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে খেলে অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও খালি কিসমিস খেতে পারেন অথবা বিভিন্ন খাবার যেমন পায়েস, সেমাই ইত্যাদিতে কিসমিস দিয়েও খাওয়া যায়।
শিম
প্রোটিন, পটাশিয়াম এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ শিম খুবই পরিচিত একটি শীতকালীন সবজি। শিম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রক্তের মান উন্নয়ন করে। এছাড়া শিমের বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জিংক যা খাবারের রুচি বাড়ায়।
ডেঙ্গু নিয়ে কিছু তথ্য
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে জ্বর আসার শুরু থেকে সচেতনতার সাথে সেবা যত্ন করলে বাড়িতে রেখে সারিয়ে তোলা সম্ভব হাসপাতালে না গিয়ে।
- ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
- জ্বর আসার প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিনে ডেঙ্গু টেস্ট করা যায় এবং রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।
- সাধারণত সপ্তাহখানেক পরে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় পর্যন্ত একজন ডেঙ্গু রোগীর জন্য ক্রিটিকাল সময় ধরা হয়। কারণ এই সময়ের মধ্যে পুনরায় ডেঙ্গু জ্বর ঘুরে আসলে সেটা পূর্বের তুলনায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়। অনেক সময়ে সরাসরি “ডেঙ্গু শাক সিনড্রোম” অবস্থায় রোগী উপনীত হয় যার ফলাফল মৃত্যু।
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় যা করা উচিত নয়
- বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোগীকে এসপিরিন জাতীয় কোন ওষুধ দেয়া যাবে না।
- প্রয়োজন না হলে শুধু জ্বর কমানোর জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যাবে না।
- শরীরের কোন শিরাতে কোন ধরনের স্যালাইন দেয়া যাবে না।
- দ্রুত সুস্থতার জন্য কোন ধরনের স্টেরয়েড ব্যাবহার করা যাবে না।
শেষ কথা
সচেতনতাই পারে আমাদেরকে ডেঙ্গু থেকে দূরে রাখতে অথবা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সহজে আরোগ্য লাভ করতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গেলে রক্তে প্লাটিলেটের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার, ফলের রস, পুষ্টিকর যে কোন খাবার, শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এ ধরনের স্বাস্থ্য সচেতন বিষয়ক আরও বেশ কিছু লেখা পড়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন এবং কোন মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url