ভিটামিন সি কেন দরকার এবং এর অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে জানুন
আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনের প্রয়োজন যেমন ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ভিটামিন ই ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে একমাত্র ভিটামিন সি যেমন একইসাথে শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকার করে থাকে তেমনি সহজলভ্য। আমরা যারা ভিটামিন সি খাই বা যারা খাই না তারা অনেকেই জানিনা ভিটামিন সি কেন দরকার।
আবার সচেতন থাকার জন্য ভিটামিন সি এর অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত। এই আর্টিকেলে ভিটামিন সি এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।
ভূমিকা
ভিটামিন সি একটি জৈব অম্ল যার রাসায়নিক নাম অ্যাসকরবিক এসিড। ভিটামিন সি শুধু মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান তাই নয় এটি অনেক প্রানীর ক্ষেত্রেও খুব উপকারী। ভিটামিন সি একটি অপরিহার্য ভিটামিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ শরীর দুর্বলতা থেকে শুরু করে শল্য চিকিৎসা (সার্জারি) সব কিছুতেই ভিটামিন সি এর প্রয়োজন হয়।
আবার ভিটামিন সি এর গ্রহণ যোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। কারণ শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূল সবকিছুতেই ভিটামিন সি বিদ্যমান। তাই আমাদের অবশ্যই জানা উচিত ভিটামিন সি কেন দরকার।
ভিটামিন সি জাতীয় খাবার কি কি
ভিটামিন সি এর একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে এটি সস্তা এবং সহজলভ্য অন্যান্য ভিটামিনের তুলনায়। আমাদের চারপাশে যেসব সাধারন খাবার আমরা খেয়ে থাকি সেগুলোর ভিতরেই খুব সহজে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। যেমন ধরুন আপনি বাজার থেকে ফল কিনেছেন, পাঁচটি ফল খেলে তার মধ্যে অবশ্যই দুটিতে ভিটামিন সি পেয়ে যাবেন। যাই হোক নির্দিষ্ট ভাবে কোন কোন খাবারে ভিটামিন সি পাওয়া যায় চলুন জেনে নেয়া যাক।
ফলঃ আম, পাকা তাল, জলপাই, কমলা, কাগজি লেবু, পাকা পেঁপে, স্ট্রবেরি, আমড়া, জাম্বুরা, আমলকি, পেয়ারা, করম চা, বেদানা, লিচু, আনারস, তাল, বরই, মালটা, লেবু, জামরুল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। সবগুলোই আমাদের খুবই পরিচিত ফল।সবজিঃ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সবজি গুলোর মধ্যে রয়েছে করল্লা, কাঁচা আম, শালগম, টমেটো, চালকুমড়া, কাঁচা টমেটো, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা কলা, পুদিনা পাতা, থানকুনি পাতা, শুকনো মরিচ, কাঁচামরিচ, সজনে ইত্যাদি।শাকঃ প্রায় সব ধরনের শাকে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যেকোনো সবুজ শাক, সরিষা শাক, বরবটি পাতা, পালং শাক, কলমি শাক, লাল শাক, করলা শাক, ধনেপাতা, সজনে পাতা, পুঁই শাক ইত্যাদি।
দিনে কতটুকু ভিটামিন সি খাওয়া উচিত
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে শিশুদের জন্য দিনে প্রায় ৩০ গ্রাম ভিটামিন সি খাওয়া যেতে পারে। স্তন্যদানকারী বা গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দিনে ১০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত খাওয়া যেতে পারে। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ দিনে ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খেতে পারেন এবং একজন পূর্ণ বয়স্ক নারী দিনে প্রায় ৭০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খেতে পারেন।
ভিটামিন সি কেন দরকার
এক কথায় ভিটামিন সি এর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। তাই বলে কি ভিটামিন সি এর উপকারিতা জানবো না? চলুন সংক্ষেপে জেনে নেই আমাদের জন্য ভিটামিন সি কেন দরকার।
- দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং দাঁতকে মজবুত করতে ভিটামিন সি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি দাঁতের মাড়ির বিভিন্ন ক্ষত সারিয়ে তোলে এবং দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করে।
- ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর মত কাজ করে বিভিন্ন ফ্রি র্যাডিকেলের মত উপাদান থেকে আমাদের কোষকে রক্ষা করে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
- এক গবেষণা থেকে জানা যায় ভিটামিন সি এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আমাদের হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেক অংশে কমে যায়।
- বাত রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন শারীর বৃত্তীয় কার্যক্রম শেষে যে বর্জ্যগুলো জমা হয় সেগুলোকে বলা হয় ইউরিক অ্যাসিড। এই ইউরিক অ্যাসিড শরীরের বিভিন্ন হাড়ের সংযোগস্থলে অর্থাৎ হাটুতে, হাতে, আঙ্গুলের ভাজে জমা হতে শুরু করে। ফলে শরীরের এইসব অংশে প্রচন্ড ব্যথা হয়, হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয়। একে বলা হয় বাত রোগ। ভিটামিন সি বাত কমাতে সাহায্য করে।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া হোক অথবা সরাসরি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া হোক না কেন, সেই ক্যালসিয়ামকে শরীরে দ্রুত শোষণের সকল ব্যবস্থা করে দেয় ভিটামিন সি।
- রক্তের প্রধান দুটি উপাদান হচ্ছে লোহিত রক্তকণিকা আর শ্বেত রক্ত কণিকা। লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন এবং সারা শরীরে অক্সিজেনের সঠিকভাবে সরবরাহ করার জন্য প্রয়োজন আয়রন। এই আয়রন যাতে শরীরে সঠিকভাবে শোষিত হতে পারে সে কাজটি সুষ্ঠুভাবে তদারকি করে ভিটামিন সি।
- ত্বকের গঠনে, ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে, ত্বকের সতেজতা বজায় রাখতে এবং ত্বকের মসৃণতা বজায় রাখতে কোলাজেন নামক একটি উপাদান বিশেষ প্রয়োজন। এই কোলাজেন উৎপাদনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে ভিটামিন সি।
ভিটামিন সি এর অভাবজনিত রোগ
নিয়মিত ভিটামিন সি খাওয়ার ফলে শরীরের যেমন অনেক উপকার হয় তেমনি ভিটামিন সি এর অভাবে অনেক রকমের রোগের সৃষ্টি হয়। আসুন জেনে নেই ভিটামিন সি এর অভাবজনিত রোগ কি কি।
- ভিটামিন সি এর অভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে অবসন্ন হয়ে পড়ে। ফলে অন্যান্য রোগের সূত্রপাত হয়।
- ভিটামিন সি এর অভাবে কোলাজেনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। কোলাজেনের অভাবে ত্বকে ভাজ পড়ে ত্বকের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ত্বকে ফুসকুড়ি এবং ব্রণের মত সমস্যা হয়।
- ক্ষতস্থান শুকানোর জন্য ভিটামিন সি ম্যাজিকের মতো কাজ করে। শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে যদি দ্রুত রক্ত বন্ধ না হয় বা সে ক্ষতস্থান যদি না শুকায় তাহলে বুঝতে হবে শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব রয়েছে।
- ভিটামিন সি এর অভাবে দাঁতের মাড়ি ফুলে যায়, দাঁত ব্যথা করে, অনেক সময় মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে।
- ভিটামিন সি এর অভাবে স্কার্ভির মত খুবই পরিচিত কিন্তু মারাত্মক রোগ হয়। স্কার্ভি রোগের কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ হল-
- শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ করা
- বেশিরভাগ সময় তন্নচ্ছন্ন হয়ে থাকা
- গিটে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হওয়া
- মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়া
- ত্বক কালচে হয়ে যাওয়া এবং ত্বকে ফুসকুড়ি, ব্রণ উঠা
- মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়া
- রক্তশূন্যতা তৈরি হওয়া
- চোখ সাদাটে বা ফ্যাকাসে ভাব হওয়া
- চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়ে চোখের নিচে কালি পড়া ইত্যাদি
- পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে জন্ডিস, খিচুনিসহ জ্বর হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।
ভিটামিন সি বেশি খেলে যা হয়
ভিটামিন সি সহজে দ্রবণীয় একটি পুষ্টি উপাদান। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি খেলে তেমন কোন সমস্যা হয় না সেটি প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। তবে মাত্রাতিরিক্ত খেলে তখনই বিপদ ঘটে। আমাদের শরীরের জন্য ভিটামিন সি অপরিহার্য এটা নিশ্চিত। তবে নিশ্চিত বলেই বেশি বেশি খেলে তারও কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। যেমন-
- মাঝে মাঝে ডায়রিয়া হয়
- বমি বমি ভাব হয় বা বমি হয়ে যায়
- মাথাব্যথা, অনিদ্রার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে
- পেটে ব্যথা হতে পারে
- এসিডিটি হতে পারে
- বুক জ্বালাপোড়া করতে পারে
- হজমের সমস্যা দেখা দেয়
- কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র, থাইরয়েড এর সমস্যা দেখা দেয়
সঠিকভাবে ভিটামিন সি গ্রহণ
আমাদের অজান্তে আমরা অনেক সময় ভিটামিন সি এর গুনাগুন নষ্ট করে ফেলি। নিচের মত কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে ভিটামিন সি এর গুনাগুন অপরিবর্তিত থাকে। যেমন-
- দিনের যেকোনো সময় ভিটামিন সি গ্রহণ করা যায় তবে সকালে খালি পেটে ভিটামিন সি খেলে শরীরে খুব দ্রুত এবং কার্যকর ভাবে শোষিত হয়।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যে কোন খাবার কাঁচা খাওয়া উত্তম এতে ভিটামিন সি কোন রকম বিকৃত না হয়ে সরাসরি আমাদের শরীরে শোষিত হয়।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সবজি যেহেতু কাঁচা খাওয়া যায় না সে ক্ষেত্রে কম আঁচে বেশিক্ষণ সিদ্ধ না করে খাওয়া উত্তম। বেশি তাপে অনেকক্ষণ ফোটালে ভিটামিন সি এর গুনাগুন নষ্ট হয়।
লেখকের মন্তব্য
পূর্বেই বলা হয়েছে ভিটামিন সি এর একটি অন্যতম বিশেষ গুণ হলো এটি খুবই সহজলভ্য একটি ভিটামিন। একটু সচেতন ভাবে আমরা যদি খাবার খাই তাহলে আমাদের ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণ করা খুবই সহজ। বাজারে আকাশচুম্বী দাম হওয়ায় অনেকে আমরা দামি ফলমূল কিনে খেতে পারি না। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত খাবারের সাথে কাঁচা মরিচ, লাল শাক, সবুজ শাক, লেবু ইত্যাদি খেলে ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হবে।
যাইহোক, ভিটামিন সি কেন দরকার এবং এর অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে জানলেন। এতক্ষন ধৈর্য নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভিটামিন সি নিয়ে অনেক তথ্য দেয়ার চেষ্টা করলাম। আশা করি আপনাদের কিছুটা হলেও উপকার হয়েছে। লেখাটা যদি ভালো লেগে থাকে তবে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর কোন রকম প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url