সাদা চিনির অপকারিতা এবং লাল চিনি কেন খাবেন জানুন

ড্রাইভিং লাইসেন্স এর বিস্তারিত জেনে নিন

বিভিন্ন উৎসব পার্বণে বা বাসাতে শখ করে কোন খাবার তৈরি করতে হলে মিষ্টি জাতীয় খাবার ছাড়া আমাদের একদমই চলে না। লবণ জাতীয় খাবার না থাকলেও মিষ্টি জাতীয় খাবার অবশ্যই থাকতে হবে। এই মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রধান উপাদান হচ্ছে চিনি। কিন্তু সাদা চিনির অপকারিতা যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

সাদা চিনির অপকারিতা এবং লাল চিনি কেন খাবেন জানুন

একই সাথে লাল চিনির গুনাগুন এবং লাল চিনি কেন খাবেন সেই বিষয়েও অনেকেরই ধারণা নেই। আজকের এই লেখায় আপনাদের সামনে লাল চিনি সাদা চিনি চিনির উপকারিতা অপকারিতা বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করব। আশা করি লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

ভূমিকা

চিনি এক ধরনের মিষ্টি উপাদান যেটি তৈরি হয় এক প্রকার গাছ বা ফলের রস থেকে। প্যারাগুয়ে এবং ব্রাজিলে “স্টেভিয়া” নামক একটি গাছ যেটি খাবার মিষ্টি করা কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেই সু প্রাচীনকাল থেকে। চিনি একটি বাংলা শব্দ যার ইংরেজি হচ্ছে Sugar এবং এর রাসায়নিক নাম হল সুক্রোজ।
এক অণু সুক্রোজ তৈরি করতে প্রয়োজন এক অনু গ্লুকোজ এবং এক অনু ফ্রুক্টজ এর কম্বিনেশন । আমাদের এশিয়া মহাদেশের সাধারণত আখ বা আখের রস থেকে চিনি তৈরি করা হয়। আখের রস থেকে সরাসরি যে চিনি পাওয়া যায় সেটি সাধারণত হালকা বাদামী রংয়ের হয়ে থাকে যেটি আমাদের দেশে লাল চিনি হিসেবে পরিচিত।

এই লাল চিনিকে ধবধবে সাদা করার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল যোগ করে রিফাইন বা পরিশোধন করে সাদা করা হয় যেটি সাদা চিনি হিসেবে পরিচিত। পরিশোধিত সাদা চিনিতে অনেক ক্ষতিকর এবং জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ অনেক উপাদান থাকায় মার্কিন বিজ্ঞানী ডঃ উইলিয়াম কোডা মার্টিন সাদা চিনি কে “বিষ” নামে অবহিত করেন। এবং একই সাথে তিনি অপরিশোধিত লাল চিনি খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

সাদা চিনির অপকারিতা

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিআরসি) এর দাবি আমাদের দেশে বাজারে যেসব সাদা চিনি পাওয়া যায় সেগুলোতে ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেট নামক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান। অথচ ২০০৬ সালে আমাদের দেশে এই বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোডিয়াম সাইক্লামেট এর স্বাদ চিনির মতোই, দেখতেও চিনির মতোই তবে দামে কম এবং চিনির চেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। আসুন জেনে নেই সাদা চিনির অপকারিতা গুলো।
  • মানব দেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সোডিয়াম সাইক্লামেন্ট।
  • পুরুষদের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে সাদা চিনি। সাদা চিনি পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী।
  • অবসাদ, কিডনি রোগের মত মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে সাদা চিনি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। একটা সময় এই সমস্যাগুলোই ক্যান্সারে রূপ নেয়।
  • শরীরে মাত্রাতিরিক্ত চিনি প্রবেশ করলে শরীরের বাইরেও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয় যেমন আমাদের মুখের ত্বকে ব্রণ উঠে, মুখের চামড়া কুচকে যাওয়া, বুড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
  • সাদা চিনিতে বিদ্যমান শর্করা আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এবং আমরা জানি গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের সূত্রপাত হয়।
  • নিয়মিত প্রতিদিন সাদা চিনি খাওয়ার ফলে সাদা চিনি নিজ দায়িত্বেই আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ যেমন হার্ট ফেইলিওর বা স্ট্রোকের মতো কঠিন রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
  • সাদা চিনি আমাদের শরীরের স্থূলতা বাড়িয়ে দেয়। স্থুলতা বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষমতা কমে যায় অর্থাৎ কাজ করতে ভালো লাগে, না শরীর ঝিমঝিম করে ইত্যাদি।
  • সাদা চিনি বলতে আমরা যা খাই মূলত সেটি সরল শর্করা। সরল হঊয়ার কারনে এটি খাওয়ার পরপরই খুব দ্রুত হজম হয়ে যায় এবং খুব দ্রুত আমাদের আবার ক্ষুধা লাগে। সাদা চিনি এভাবে আমাদের ক্ষুধার উপর নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করে।
  • আমাদের দাঁতের উপরে এনামেল নামক একটি প্রলেপ থাকার কারণে দাঁত চকচক করে। তবে নিয়মিত সাদা চিনি গ্রহণে দাঁতের উপরের এনামেল নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য যারা বেশি চিনি খায় অথবা চিনিসহ চা খায় তাদের দাঁতের অবস্থা ভালো থাকে না।
  • এছাড়াও অতিরিক্ত চিনি অল্প বয়সে আমাদের দাঁতের বিভিন্ন রকম সমস্যা করে যেমন মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, দাঁত পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
  • সাদা চিনি বা সরল শর্করা বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে সেটি আমাদের ওজন বৃদ্ধি করে, স্থূলতা বাড়িয়ে দেয় এবং পেটের চর্বি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড বা চিনি জাতীয় খাদ্য গ্রহণকারী ব্যক্তি সাধারণ ব্যক্তিদের চেয়ে প্রায় ৩০% বেশি হতাশার মত মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন।
  • চিনিকে ধবধবে সাদা করার জন্য লাল চিনিকে রিফাইন বা পরিশোধন করতে হয়। এই পরিশোধনের কারণে লাল চিনিতে অবস্থিত বিভিন্ন মিনারেল, প্রোটিন, এনজাইম, ভিটামিন এবং অন্যান্য উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। চিনি পরিশোধনের জন্য প্রয়োজন হয় হাড়ের গুড়া এবং সালফার।
  • পরিশোধিত সাদা চিনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করার পাশাপাশি কিডনি এবং হাটের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে এবং ব্রেনের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে।

কতটুকু চিনি খাওয়া প্রয়োজন

উপরের আলোচনা থেকে সহজে আমরা বুঝতে পারছি সাদা চিনি আমাদের শরীরের জন্য কতটা ভয়ানক ক্ষতিকর। অনেকেই হয়তো ভাবছেন তাহলে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাপারটা সেরকম নয়। শরীরের জন্য চিনি প্রয়োজন তবে সেটা অবশ্যই পরিমাণ মতো এবং লাল চিনি হতে হবে ।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর মতে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ প্রতিদিন নয় চা চামচ বা ৩৬ গ্রাম বা ১৫০ ক্যালোরি চিনি খেতে পারবেন। এবং একজন পূর্ণবয়স্ক মহিলার ক্ষেত্রে এই পরিমাণটি হল ছয় চা চামচ বা ২৫ গ্রাম বা ১০০ ক্যালরি চিনি।

অতিরিক্ত চিনি থাকে যেসব খাবারে

আমরা যখন তখন যেখানে সেখানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড, জাঙ্ক ফুড বা কনফেকশনারি থেকে বিভিন্ন খাবার খেয়ে খাকি। এসব খাবারে ভয়াবহ পরিমাণে অতিরিক্ত চিনি থাকে যেটা আমাদের শরীরের জন্য হুমকি স্বরূপ। যেমন
  • বিভিন্ন সফট ড্রিংকস ২৫ শতাংশ
  • কফি বা চা ৭ শতাংশ
  • বিভিন্ন এনার্জি ড্রিংস ৩ শতাংশ
  • বিভিন্ন ফলের জুস ১১ শতাংশ

সাদা চিনির বিকল্প

এতক্ষণ পর্যন্ত উপরে আলোচনা থেকে আমরা এটুকু নিশ্চিত হলাম যে সাদা চিনি আমাদের শরীরের জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর। যারা চিনি বা চিনি জাতীয় খাবার খুবই পছন্দ করেন তারা হয়তো চিন্তায় পড়ে যাবেন যে এখন কি করতে পারি আমরা। চিকিৎসক বা পুষ্টিবীর না হয়েও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ছোট্ট কিছু সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছি। চিনির পরিবর্তে আমরা এমন কিছু ব্যবহার করতে পারি যেগুলো স্বাদে মিষ্টি। যেমন
  • মধু হতে পারে একটি বিকল্প মিষ্টি জাতীয় খাবার। শুধু মধু খেতে পারবেন যেকোনো খাবারের সাথে মধু মিশিয়ে খাওয়া যায় যেমন আপনি পায়ে সে মধু দিতে পারেন চিনির পরিবর্তে চায়ের সাথে মধু খেতে পারেন যেকোনো মিষ্টি তে খাবারে চিনি পরিবর্তে আপনি মধু ব্যবহার করতে পারেন।
  • এরপরে বিকল্প হিসেবে বলা যেতে পারে বিভিন্ন মিষ্টি ফল। যেমন কলা, আপেল, আঙ্গুর ইত্যাদি। এই ফলগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি বা শর্করা বিদ্যমান যেটা আমাদের শরীরের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। তাই কারো মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় জিনিস খেতে ইচ্ছা করলে সাদা চিনির পরিবর্তে মিষ্টি ফল খেতে পারেন।
  • সাদা চিনির বিকল্প হিসেবে আপনার পছন্দের তালিকায় থাকতে পারে গুড়। এটি একটি সহজলভ্য মিষ্টি খাবার। চিনির মতো এটিও আপনি খালি মুখে খেতে পারেন। এটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করেও খেতে পারেন। বর্তমানে গুড়েও বেশ কিছু কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে তারপরও সাদা চিনির চেয়ে গুড়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম।
  • সবশেষে সাদা চিনির পরিবর্তে লাল চিনি ব্যবহার করতে পারেন যদিও আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় খুবই কম পরিমাণে উৎপন্ন হয় লাল চিনি। লাল চিনি পরিশোধন করা হয় না বিধায় এতে কোন কেমিক্যাল থাকে না এবং স্বাস্থ্যের জন্য এটি উপকারী।

লাল চিনি কেন খাবেন

অনেকে আছেন লাল চিনি খেতে চান না কারণ লাল চিনি দেখতে কিছুটা বলতে ভাব হয় তারা এটি পছন্দ করেন না। হয়তো লাল চিনির গুনাগুন না জানার কারণেই অনেকে এমনটা করে থাকে।
  • লাল চিনি কেন খাবেন এর উত্তরে সহজ কথায় যদি বলি তাহলে বলা যেতে পারে লাল চিনি একটি অপরিশোধিত চিনি অর্থাৎ এই চিনি তৈরি করার সময় কোন রকমের প্রসেসিং করা হয় না যার ফলে এতে কোন কেমিক্যাল যুক্ত হয় না এবং এটি একদম নির্ভেজাল খাঁটি চিনি।
  • লাল চিনি আখের রস থেকে তৈরি করা হয় এবং এই আখের রসে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যামাইনো এসিড, লৌহ, শর্করা, ফলিক এসিড, জিংক, এন্টি অক্সিডেন্ট সহ আরো বেশ কিছু উপাদান।
  • লাল চিনিতে অধিক মাত্রায় বিদ্যমান ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় মজবুত করে।
  • লাল চিনির ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন থেকেও দূরে রাখে আমাদের দাঁতকে।
  • আখের রসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের ভেতরের বিভিন্ন টক্সিক উপাদানকে বের করতে সাহায্য করে এবং আমাদেরকে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে দূরে রাখে।
  • যারা মুখে রুচি সমস্যায় ভুগছেন তারা রুচি বাড়াতে মাঝেমধ্যে লাল চিনির শরবত খেতে পারেন।
  • সর্বদা লাল চিনির ব্যবহার আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
  • লাল চিনিতে বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে খনিজ উপাদান আমাদের মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
  • লাল চিনি লিভার সুস্থ রাখার পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূর করে এবং একই সাথে জন্ডিসের প্রকোপ কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
লেখকের মন্তব্য
আমাদের প্রত্যেকেরই পছন্দের খাবারের তালিকায় থাকে মিষ্টি জাতীয় খাবার। মিষ্টি জাতীয় খাবারে আমাদের জিহ্বার স্বাদের কথা শুধু চিন্তা না করে আমাদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সাদা চিনি পরিহার করে লাল চিনি অথবা গুড় ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। তবে লাল চিনি বা গুড়ের ব্যবহার অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে হতে হবে। অতিরিক্ত যে কোন কিছুই আমাদের শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।
উপরের আলোচনা থেকে আশা করি সাদা চিনির অপকারিতা এবং লাল চিনি কেন খাবেন তার পরিষ্কার একটা ধারণা পেয়েছেন। তাই সুস্থ থাকতে সাদা চিনিকে না বলুন এবং লাল চিনি পরিমানে কম খান। আর্টিকেলটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে পারেন আর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url