ঘুমের সঠিক সময় এবং কম ঘুমানোর কুফল
আরামের অপর নাম ঘুম। শুধু আরামই নয় সুস্থ্য থাকতেও ঘুমের দরকার অপিরিসিম। এ কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ঘুমের সঠিক সময় কখন এবং সঠিকভাবে না ঘুমালে অর্থাৎ কম ঘুমানোর কুফল কি কি এসব আমাদের অনেকেরই জানা নেই।
আবার ঘুম নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নাই। কারো একদমই ঘুম নেই তো আবার কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠতেই চায় না। ঘুম নিয়ে নানা সমস্যা সমাধান উপকারিতা অপকারিতা এসব কিছু নিয়ে আজকের এই আর্টিকেল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়বেন আশা করছি।
ভূমিকা
আমাদের জীবনের সাথে খুবই পরিচিত একটি শব্দ ঘুম। মানুষ, স্তন্যপায়ী প্রাণী সহ অন্যান্য যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে ঘুম একটি শারীর বৃত্তীয় কাজ। শরীরের একটি বিশেষ অবচেতন অবস্থা হল ঘুম। ঘুম শরীরের ক্লান্তি ভাব দূর করে আমাদেরকে তরতাজা হতে সাহায্য করে। ঘুম ছাড়া একদিনও আমরা থাকতে পারিনা।
তবে ঘুম নিয়ে অনেকে অনেক ঝামেলার মধ্যে দিন কাটান যখন তাদের ঠিকমতো ঘুম হয় না আবার অনেকে আছেন যারা সারাদিনে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে অতিরিক্ত ঘুমান। যাই হোক ঘুম একটি বাংলা শব্দ যার ইংরেজি শব্দ হচ্ছে Sleep , Slumber. ঘুমের কিছু সমার্থক শব্দ হচ্ছে তন্দ্রা, নিদ্রা, নিদ, বিশ্রাম, সুপ্তি ইত্যাদি। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দিনে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন।
ঘুম কত ধরনের হয়?
কত ধরনের ঘুম?- এ প্রশ্ন শুনলে অনেকে অবাক হতে পারেন, ঘুম তো ঘুমই এর আবার প্রকারভেদ কি? হ্যা, প্রকারভেদ আছে।
দিনের ঘুমঃ দুপুরবেলা খাবার পরে ১০-১৫ মিনিট বা আধা ঘন্টা অনেকের ঘুমানোর অভ্যাস থাকে এটিকে ইংরেজিতে Nap বা Cat Nap বলে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ঘুম “ভাতঘুম” নামেও পরিচিত।পাতলা ঘুমঃ অনেক ব্যক্তির ঘুম এতই পাতলা থাকে যে একটা কাগজের পৃষ্ঠা যদি হাত থেকে পড়ে যায় তবুও তার ঘুম ভেঙে যায়। গবেষণা মতে এই ধরনের ঘুমের ব্যক্তিরা খুব সচেতন হয়ে থাকেন।গাড় ঘুমঃ এই ধরনের ঘুম হলো পাতলা ঘুম এর বিপরীত অর্থাৎ এই ঘুমের অধিকারী ব্যক্তি এতই গভীরভাবে ঘুমান যে তার বাসায় চুরি হয়ে গেলেও সে কিছুই টের পায় না।তন্দ্রাচ্ছন্নঃ বাসে বা ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় ঝাকুনিতে যে ঘুমঘুম ভাব আসে বা অবচেতন অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটা হচ্ছে তন্দ্রাচ্ছন্ন। এটি ঘুমের একটি আংশিক অংশ। কাশি নিবারনের জন্য বেশ কিছু সিরাপ আছে যা খেলে অনেক সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়।
ঘুমের সঠিক সময়
সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে চাইলে আপনাকে নিয়মিত এবং সময়মতো প্রতিদিন ঘুমাতে হবে। একজন সচেতন ব্যক্তির ঘুমের সঠিক সময় জানা অত্যন্ত জরুরী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে একজন ব্যক্তির রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া উচিত এবং ভোর পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা উচিত। এই সময়টা মেনে চললে সারাদিন শরীর যেমন সুস্থ থাকবে তেমন আপনার কর্মব্যস্তময় দিন ভালো কাটবে।
ভাল ঘুমের ১০ উপকারিতা
ঘুমের সঠিক সময় হচ্ছে রাত। আমরা দিনেও মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে থাকি তবে সেটা কিছুক্ষণের জন্য ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে। তবে সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যই আমাদের রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।আমাদের শরীরের সমস্ত কার্যক্রমকে ঠিক রাখার জন্য ঘুম ওষুধের মত কাজ করে।
- রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেলে সারারাত যেমন আপনার ঘুমটা ভালো হবে ঠিক তেমনি সারাদিন আপনার মানসিকভাবে আপনি ফুরফুরে মেজাজে থাকবেন ফলে আপনার মনের বিরুদ্ধে কোন কিছু হলে দ্রুত আপনি রেগে যাবেন না বা আপনি মেজাজ হারাবেন না। তাই অন্যের সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য ভালো ঘুমের বিকল্প নেই।
- সুইডেনের একদল গবেষকদের দাবি নিয়মিত দৈনিক ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমালে চেহারার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, ত্বকের উজ্জ্বলতা বহুগুণ বেড়ে যায়।
- আপনার যদি ওজন বাড়তে থাকে তবে অবশ্যই আপনাকে ভালো করে ঘুমাতে হবে চিকিৎসকদের মতে ভালো এবং সঠিকমাত্রার ঘুম ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- দৈনিক নিয়ম করে রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লে বিভিন্ন রকম রোগ যেমন কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ রোগের মত মারাত্মক রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
- রাতে ভালো ঘুমের পরে খুব সকালে যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন আপনার শরীর এবং মন যেমন ফুরফুরা থাকবে তেমনি আপনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন।
- রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে ৮ থেকে ৯ ঘন্টার একটা লম্বা ভালো ঘুম দিলে আপনার সারাদিন ক্লান্তি অনুভব হবে না। দুপুরে আপনি বিশ্রাম নিতে না পারলেও ক্লান্তি বোধ করবেন না ।
- যারা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে একটা ভালো ঘুম দেয় তারা সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্তে থাকতে পারে কারণ রাতে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমালে স্বাভাবিকভাবেই সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবে এবং সারা দিন সে কাজ করার জন্য প্রচুর সময় পাবে।
- এক গবেষণায় দেখা গেছে রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লে হজম শক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়। এতে বিভিন্ন ধরনের পেটের পিড়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- ভালো পর্যাপ্ত ঘুমের আরেকটি বিশেষ গুণ হচ্ছে এটি আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে।
- গরম থেকে শীতকাল এবং শীতকাল থেকে গরমকাল আবির্ভাবের সময় আমাদের চারপাশে পরিবেশে বাতাসে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ঘুরে বেড়ায়। এসব জীবাণু দ্বারা সহজে আমরা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টাতে নিজেকে সুস্থ এবং ফিট রাখতে অবশ্যই আমাদের পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমাতে হবে। চিকিৎসকদের এমনটাই মত।
অতিরিক্ত ঘুমালে কি কোন অসুবিধা হয়?
যেকোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয় তাই অতিরিক্ত ঘুমেরও বেশ কিছু খারাপ প্রভাব আছে। কম ঘুমানোর কুফল রয়েছে যেমন ঠিক তেমনি অতিরিক্ত ঘুমানোর বেশ কিছু খারাপ দিক আছে।
- কোনদিন আপনি বেশি ঘুমালেন কোনদিন কম ঘুমালেন আবার কোনদিন আপনি স্বাভাবিক ঘুমালেন। এভাবে ঘুমালে আপনার ঘুমের যে রুটিন সেটাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে যার ফলে আপনি হতাশায় ভুগবেন।
- মাইগ্রেন কি ধরনের একটি কষ্টদায়ক সমস্যা সেটা তারাই বুঝে যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। এখন বলতে পারেন মাইগ্রেনের সাথে ঘুমের কি সম্পর্ক? চিকিৎসকের মতে অনিয়ন্ত্রিত ঘুমের কারণে বা যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমায় তাদের মাইগ্রেন হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।
- আপনার কাজ নেই অথবা আপনি অলস ব্যক্তি বলেই যে আপনি দশ থেকে বারো ঘন্টা ঘুমাবেন ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। একটানা অনেকক্ষণ ঘুমানোর ফলে আপনার পেশিতে ব্যথা হতে পারে, আপনার কোমরে ব্যথা হতে পারে।
কম ঘুমানোর কুফল
আমাদের বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, বিভিন্ন পেপার পত্রিকা পড়ে চিকিৎসকের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে সুস্থ শরীরের জন্য ঘুম কতটা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সমাজে এর উল্টা ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। এখন তরুণ সমাজ সারারাত জেগে সারাদিন ঘুমায়। গল্পগুজব, আড্ডায়, মোবাইলে গেম খেলে, মুভি দেখে, রাতে না ঘুমিয়ে সময় অপচয় করে।
ফলাফলস্বরূপ আমাদের তরুণ সমাজের মাঝেও অনেক কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আসুন জেনে নেই কম ঘুমানোর কুফল সম্পর্কে অর্থাৎ ঘুমের অভাবে কি কি সমস্যা হতে পারে।
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা কমে যায় এর ফলে বিভিন্ন ধরনের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ঠিকমতো না ঘুমালে আমাদের মানসিকভাবে আমরা প্রশান্তি অনুভব করি না এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। অন্যের সাথে আমরা বাজে ব্যবহার করে থাকি।
- সারা রাত জেগে সকালে ঘুমাতে গেলে বিভিন্ন ধরনের এসিডিটির সমস্যা দেখা দেয়।
- রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব আমাদের রক্তের শর্করা কে বাড়িয়ে দেয় এবং ইনসুলিনের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- নিয়মিত রাতে না ঘুমিয়ে জেগে থাকলে ক্ষুধা বেশি পায় আর ক্ষুধা বেশি পেলে অবশ্যই খেতে হব। আর বেশি খেলে ক্যালরি যেমন বেশি শরীর গ্রহণ করবে ঠিক তেমনি ওজনটা বেড়ে যাবে। আর ওজন বৃদ্ধির ফলে শরীরে নানা রকম অসুখের সৃষ্টি হতে পারে।
- সুইডেনের একদল গবেষকের মতে রাতে নিয়মিত না ঘুমালে চোখ ফুলে যায়, চোখ লাল হয়ে যায়, চোখের নিচে কালি পড়ে যায় এবং চেহারার ত্বকেও একটা খারাপ প্রভাব পড়ে।
- রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই বিভিন্ন ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
লেখকের মন্তব্য
বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার প্রয়োজন তেমনি সুস্থ্য ভাবে বেচে থাকার জন্য ঘুমের দরকার। আর পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য সবার আগে জানা প্রয়োজন ঘুমের সঠিক সময়। সারা দিন কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত রাতের ঘুমের প্রতি।
ঘুম নিয়ে আর্টিকেলটি আপনার প্রিয় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে শেয়ার করতে পারেন। আর কোন মন্তব্য থাকলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট লিখে জানাতে পারেন।
মুবিন পিডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url